পাবনা জেলা সদর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে ঐতিহাসিক চলনবিল অধ্যসিত ছায়া ঢাকা, পাখি ঢাকা, শামত্ম অঞ্চল ফরিদপুর উপজেলা। এ উপজেলার উত্তরে ভাঙ্গুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলা, পূর্বে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলা, দক্ষিণে সাঁথিয়া ও আটঘরিয়া উপজেলা এবং পশ্চিমে চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলা। ভৌগলিকভাবে ২৪০০৫’-২৪০১৪ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯০১৭-৮৯০২৭ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে এর অবস্থান। এ উপজেলার আয়তন ১৪৫.৪৭ বর্গ কিলোমিটার।
ফরিদপুর উপজেলা পাবনা জেলার প্রাচীনতম উপজেলার মধ্যে একটি। ১৯২০ সালে এটি থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২ জুলাই ১৯৮৩ তারিখে আপগ্রেডেড থানা (উপজেলা) হিসেবে ঘোষিত হয়। একটি পৌরসভা ও ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে এ উপজেলা গঠিত।
ফরিদপুর উপজেলা নামকরণের বিষয়ে সুনিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয় যে, বহু বছর আগে সুফি সাধক শেখ শাহ ফরিদ (রহঃ) এ অঞ্চলে ভ্রমণে আসেন এবং এ উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে বসবাস করেন। এখানে তাঁর মাজার রয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস, সুফি সাধক শেখ শাহ ফরিদ (রহঃ) এঁর নামানুসারে এ উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে ‘‘ফরিদপুর’’।
সুফি সাধক শেখ শাহ ফরিদ (রহঃ) এর পুরো নাম হযরত শেখ শাহ ফরিদ গঞ্জে গাফ্ফার আল-মক্কী (রহঃ)। সৌদি আরবের মক্কাতে বাড়ি হওয়ায় তার নামের শেষে আল-মক্কী ব্যবহার করা হয়।
আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা লাভের জন্য মক্কা শরীফ থেকে ইরাকে যান। সেখানে বড়পীর হযরত শেখ আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর নাতি হযরত শেখ আব্দুল কুদ্দুস ওরফে শাহ মখদুম রুপোশ (রহঃ) এর শিষ্যতো গ্রহন করে তার থেকে আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা লাভ করেন। তার সাথে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আগমন করেন।
পাবনা জেলার হিন্দু অধ্যুষিত ফরিদপুর উপজেলায় তাশরিফ আনেন হযরত শেখ শাহ ফরিদ আল-মক্কী (রহঃ)।
স্থানীয় জনশ্রুতি মতে ও বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, প্রায় সারে সাতশো বছর আগে এ এলাকাটি ঘন জঙ্গল ছিল। তিনি এখানে প্রথম একটি মসজিদ নির্মান করেন। যেটি সাতশো বছরেরও অধিক প্রাচীন। এই মসজিদটিই ছিলো তার হুজরা শরীফ। যেখানে বসে তিনি মানুষকে ইসলামের আলোতে আলোকিত করেছেন।
শাহ মখদুম রুপোশ (রহঃ) এর ভাবশিষ্য শেখ শাহ ফরিদ আল-মক্কী (রহঃ) ও তার দুজন সফর সঙ্গীসহ ৬৮৭ হিজরি, ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে পদ্মানদী থেকে কুমিরের পীঠে চড়ে চারঘাট হয়ে বড়াল নদী বেয়ে সারকেল সারি ঘাটে (বর্তমান পার-ফরিদপুর) এসে থামেন। জায়গাটি তখন গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। শেখ শাহ ফরিদ আল-মক্কী (রহঃ) সেখানে আস্তানা গাঁড়েন। তাঁর আল্লাহ ভক্তি ও বিভিন্ন কেরামতি দেখে এলাকায় তাঁর অনেক ভক্তবৃন্দ তৈরি হয়।
শেখ শাহ ফরিদ আল-মক্কী (রহঃ) এর ওফাতের পর, পদ্মা নদীর বিভিন্ন কুমির প্রতি বছর ২/৩ বার বর্তমান মাজার শরীফ সোজা বড়াল নদীর ঘাটে ভেসে উঠে কিছুক্ষণ থেকে চলে যেত। কিন্তু কখনো কোন মানুষকে আক্রমণ করতেন না। এক ব্যক্তি শিকারে এসে ভুল করে কুমিড়কে গুলি ছুড়লে তারপর থেকে এখানে আর কোনো কুমিড় চোখে পড়েনা। এলাকার বয়স্ক মানুষ এসপি ইব্রাহিম হোসেন খান ও ডাঃ আব্দুল কাশেম সরকারসহ অনেকেই নিজ চোখে তা দেখেছেন। তার আল্লাহ প্রদত্ত কুদরতি শক্তিতে শুধু কুমির নয়, বনের বাঘ ভাল্লুকও তার আদেশ পালন করতো।
ভারতের ফুরফুরা শরীফের দাদা হুজুর মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রহঃ) ও তার দুজন খলিফা হযরত নওয়াব আলী পীর সাহেব (রহঃ) ও অত্র এলাকার অলিয়ে কামেল হযরত শাহ সূফী আলীম উদ্দিন (রহঃ) এবং রাসূলনোমা দরবার শরীফের পীর সাহেব হযরত নূরী বাবা আলাউদ্দিন শাহ আল-কাদেরী (রহঃ) এবং মাওলানা ইয়াকুব আলী সাহেব গনও এই মাজার শরীফ জিয়ারত করতে আসতেন।
মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রহঃ) এই মাজার শরীফের স্থান সনাক্তকরণ করেন। ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর এই মাজারে ওরস শরীফ উপলক্ষে গিলাফ কাফেলা নিয়ে আসেন রাসূলনোমা দরবার শরীফের খলিফা ও পাবনার ভাঙ্গুড়া পৌরসভার বাসিন্দা হযরত বাবা ইসমাইল শাহ আল-কাদেরী।
প্রতি বছর ওরশ শরীফ উপলক্ষে দিনব্যাপি চলে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, মাজার জিয়ারত, ওয়াজ নসিহত, মিলাদ মাহফিল ও তবারক বিতরণ করা হয়। ওরশের আগের দিন থেকেই জেলার প্রত্যন্ত এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানতের চাল, মুরগী, কবুতর, গরু-ছাগল ও নগদ টাকা-পয়সাসহ ভক্তরা সমবেত হন ঐতিহাসিক মাজার প্রাঙ্গণে। এ উপলক্ষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
এছাড়াও মুন্সী মোঃ আফছার আলী খাঁন সাহেব ও পরবর্তীতে প্রভাষক মাওলানা আসাদুজ্জামান আল-কাদেরী সাহেব অত্র এলাকার মুরুব্বিআন ও সর্বসাধারনকে নিয়ে ২০১১ ইং সাল হতে প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের ৩য় বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বিশ্ব বরেণ্য আউলিয়া হযরত শেখ শাহ ফরিদ গঞ্জে গাফ্ফার আল-মক্কী (রহঃ) এর স্বরণে বাৎসরিক ওরশ শরীফ উদযাপন করা হয়।