ছোটগল্প- মামপি

রাজধানী টাইমসের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মামপিকে বাগে আনতে পারছে না মাজদুল । মামপি তো এমন করে না কখনও। ডারার পাড়ে ছেড়ে দিলে অনেক রাত সে মনের আনন্দে ঘাস খায়। ভাড়া থেকে এসে মামপিকে ডারায় ছেড়ে দিয়ে কাছের বাজারে আড্ডা মারতে যায় মাজদুল। দোকানে আড্ডা মেরে বাড়ি এসে সে ভাত খায়। তারপর দড়ির আগুনে বিড়ি লাগিয়ে মামপির খোঁজ নিতে যায় সে। ততক্ষণে মামপি কচি ঘাস খেয়ে মাজদুলকে ডাকতে থাকে। মাজদুল জানে কোন খারাপ লোক মামপির কাছে ঘেষতে পারবে না। পা দিয়ে এমন লাথি মারবে যে এক কদমও এগুতে পারবে না। ডারার পাড়ে উঁচু রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাজদুল আওয়াজ দেয়-
‘মামপি। চলে এস। রাত বেশি নেই। ঘুমাতে হবে।’
মাজদুলের ডাক শুনে মামপি সাড়া দেয়। মনে হয় সে বলে,
‘আসছি। ভালো ঘাস এখানে। ছাড়তে মন চায় না।’
মামপির জন্য অপেক্ষা করে মাজদুল।
ডারার বাতাস লাগছে মাজদুলের গায়ে। আজ মনটা দারুণ ফ্রেস। সকালে পাঁচ’শ টাকার ভাড়া নিয়ে গেছে যাত্রাপুরের হাট। ভাড়া ফেলে মামপিকে কাশের লকলকা বাতারিতে ছেড়ে দিয়েছে। এক ঘন্টাও লাগেনি। ঘাস খেয়ে পেট ঢোল করে আনন্দে লেজ নাড়তে শুরু করেছে মামপি। তারপর বাজারে এনে চানাচুর আর ছোলাবুট কিনে দিয়েছে। তা খেয়ে মামপি খুশিতে টগবগ করে মাজদুলের গা চেটে দিতে থাকে। এর অর্থ সে সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে চায়। এর মধ্যে এক পাইকার এসে বলে,
‘ভাই, ভাড়া নিয়ে যাবেন?
‘কোথায় যাওয়া লাগবে।’
‘বেশি দূর নয়। বালারহাট।’
‘কত দেবেন।’
‘মন দশেক কলাই। বলেন কত নেবেন।’
‘চার’শ হলে পারব।’
‘তিন’শ দেব।’
‘পঞ্চাশ ধরে দেন।’
‘ঠিক আছে। একটু জলদি যেতে হবে।’

বালারহাটে ভাড়া নামিয়ে মামপিকে হোটেলের গমের রুটি আর ঘনডাল খাওয়ায় মাজদুল। তা খেয়ে মনের আনন্দে মামপি বাড়ির দিকে আসে। কিন্তু এখন ও বড় বিরক্ত করছে। কচি ঘাস ছেড়ে সে উঠতে চাচ্ছে না। কী হল মামপির! পরশু ওকে নিয়ে গিয়েছিল লালমনিরহাটের গোশালা মার্কেট। রডসিমেন্ট নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাড়ির দিকে রওনা করেছিল। মামপিকে কিছুই খাওয়ানো হয়নি। কুলাঘাট বাজারে সে পরোটা আর লাল চা খেয়েছিল। মামপিকে দিয়েছিল পটেটো স্লাইচ আর মুড়িচানা। খিলিপানে বাবা জর্দা মিশিয়ে সে দিয়েছিল ওর মুখে পুরে। এর আগে মাজদুলের একটা বোঝারী ঘোড়া ছিল। সে তাকে নিয়মিত বিড়ি খাওয়াতো। ঘোড়াটা ওতে এত অভ্যস্ত হয়েছিল যে বিশ পঁচিশ মন জোব নিয়ে অনায়াসে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিত। জর্দা মাখা পান মামপির মাথায় ধরেছে। একটু রাগ হয়েছে সে। এটাও হতে পারে লালমনিরহাটে তাকে কেন ঝালচানা আর মিল্কক্যান্ডি খাওয়ানো হয়নি। আগের মালিক মনে হয় গরম পরোটা খাওয়াতো। এখন থেকে দূরের হাটে গেলে সে মামপিকে খিচুড়ি আর ভুনাবুট খাওয়াবে।

মামপি বিল থেকে উঠে আসতে দেরি করছে। মামপি অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে নাতো? না বুঝে মুখে পান দেয়া ঠিক হয়নি। অবোধ জিনিষ। কী করে জানবে জর্দা দেয়া পানের মর্ম। পানের রসের সাথে জর্দার নির্যাস কী মজাই না সৃষ্টি করে। আর দেরি করতে পারছে না মাজদুল। রাত অনেক হয়েছে। সকালে কালিগঞ্জ যেতে হবে ঝোলা গুড় নিয়ে। ঠিকমতো ঘুম না হলে কালিগঞ্জ যাবে কেমন করে। গড় থেকে দোলায় নেমে গলা ছেড়ে ডাকতে থাকে সে।
‘মামপি। জলদি আসো সোনা।’

বিজ্ঞাপন

ডাক শুনে কাছে এসে দাঁড়ায় মামপি। গা ঘেষে দাঁড়িয়ে হাত চাটতে থাকে। আদর কওে বুকে পেটে হাত বুলিয়ে মাজদুল বুঝতে পারে খাওয়া ভালোই হয়েছে। বাড়িতে নিয়ে ওর গা মুছে দেয় সে। পায়ের কাদা ধুইয়ে কয়েল জ্বালিয়ে মশা তাড়ানোর ব্যবস্থা করে। যা মশা হয়েছে। মশার কামড়ে মামপির ঘুম হয় না রাতে। বেশ কিছুক্ষণ মামপির মাথার চুলে নরম করে হাত বুলায় মাজদুল। ওর হাতের পরশ পেয়ে মামপির নেশা লাগে। ইশারায় সে মাজদুলকে আরও খানিক ওর কাছে থাকতে বলে। কুলায় করে টাটকা খৈল আর চালভাজা নিয়ে আসে মাজদুল। এটুকু মামপির জন্য বাড়তি বাজেট করেছে সে। কুলার দিকে দেখে মামপি চুপ করে থাকে। মাজদুল ওকে সোহাগ করে মুখে তুলে দেয়। খুব মজা করে মামপি খৈল চালভাজা খায়।

ঝোলা গুড় নিয়ে কালিগঞ্জ পৌঁছতে জোহর নামাজের সময় হয়। গুড়ের মহাজন নামাজ পড়তে গেছে। নামাজ পড়ে উনি খাওয়ার জন্য বাড়ি যাবেন। খাওয়ার পর বিছানায় কাত হওয়ার অভ্যেসও আছে তার। অতএব মাল খালাস করতে মাজদুলের অনেক সময় লাগবে। এই অবসরে মামপির খাওয়ার দিকে মনোযোগ দেয় সে। কালিগঞ্জ বাজরে একটাই খাওয়ার হোটেল। সেখান থেকে পরোটা ঘনডাল কিনে মামপিকে খাওয়ায় মাজদুল। নলকুপ ঠেসে প্লাষ্টিকের বালটিতে পানি ভরে ওর তৃষ্ণা নিবারণ করে। কাঁঠাল গাছের ঘন ছায়ায় মামপিকে বেঁধে রেখে টিফিন বক্স থেকে নিজের খাবার খায় সে। অন্য তাগদা সেরে গুড়ের পাইকার ভাড়া মেটাতে বিকেল হয়ে আসে। নাগেশ্বরীতে আর একটা ভাড়া পৌঁছে দিতে রাত হয়ে যায় মাজদুলের। মামপিকে কিছু না খাওয়ালে মাজদুলের কিছুই খেতে ইচ্ছে কওে না। বাড়ি পৌঁছতে বেশ রাত হবে। অতএব মামপিকে হালকা নাস্তা খাওয়ায়ে নিলে ভালো হয়। সে মামপিকে জিজ্ঞেস করল,
‘মামপি, বুট চানা খাবে? ’
‘লাগবে না। আপনি খেয়ে নিন।’
‘পথে কিছু পাওয়া যাবে না। মুড়ি ছনবাবরি খাও।’
‘খিদে নেই। পরোটা পেট ফাঁপিয়ে দিয়েছে।’

মামপির মনোভাব বুঝতে পেরে চালের খুদ আর ছোলাবুট কিনে নেয় মাজদুল। মামপির শরীর খুব একটা ভালো না। ওকে ঘন ঘন খেতে দিতে হয়। এলাকার দু’একটা ঘোড়ার গাড়ি দেখল মাজদুল। সেসব গাড়ি অনেক দেরিতে রওনা দেবে। ঝটপট যাত্রা শুরু করল সে। নাগেশ্বরী থেকে ফুলবাড়ী যাওয়ার সোজা রাস্তাই ধরল মাজদুল। কিন্তু শুকাতি বোর্ডঘরের কাছাকাছি এসে হঠাৎ করে পথচলা বন্ধ করল মামপি। টর্চ জ্বালিয়ে রাস্তা পরখ করল মাজদুল। রাস্তায় কোন সমস্যা আছে বলে মনে হল না তার। অনেক সময় রাস্তায় সাপ বা বিষাক্ত পোকামাকড় থাকলে ঘোড়া তা দূর থেকে বুঝতে পারে। রাস্তায় যদি গর্ত সৃষ্টি হয় অথবা কোন ব্রীজ বা কালভার্ট ভেঙ্গে গেলেও ঘোড়া রাস্তা পরিবর্তন করে অন্য পথে চলতে শুরু করে। কিন্তু আজ মামপির কাণ্ড বুঝতে পারল না মাজদুল। যে পথে তারা এসেছে মামপি ওই পথেই ফিরে যেতে চায়। হাতের ছড়ি দিয়ে ওকে বেশ পিটুনি লাগাল সে। এ রকম গোয়ার্তুমির কোন মানে হয় না। নতুন ঘোড়া। পথ নাও চিনতে পারে। এজন্য মাজদুল গাড়ির সামনে হ্যারিকেন লটকিয়ে ওর লাগাম ধরে সামনে চলতে লাগল। কিন্তু মামপি নাছোড়বান্দা। ও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে পা দিয়ে মাটি খুজতে লাগল। অনেক চেষ্টা করে ওকে বাগে আনতে না পেরে হাল ছেড়ে দিল মাজদুল। ওর যেদিকে ইচ্ছে যাক। কোন জোর খাটাবে না সে।

বিজ্ঞাপন

চুপ করে ওর কাণ্ড প্রত্যক্ষ করতে লাগল মাজদুল। সোজা পূর্বদিকে হেঁটে হাসপাতালের সামন দিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে পাকা রাস্তা ধরে দক্ষিণে রওয়ানা দিল মামপি। কোন গতি পরিবর্তন না করে বেপারীর হাট পার হয়ে কদমের তলে এসে পশ্চিমে বেঁকে ডাকিনির পাড়ের দিকে যেতে লাগল সে। মাজদুল বুঝল মামপি স্কুলেরহাটের দিকে যেতে চায়। সোজা গেলে এতক্ষণে খড়িবাড়ী পার হয়ে নাগদহ ধরা ধরা হত। কিন্তু সোজা না যেয়ে মামপি এতদূর রাস্তা ঘুরছে কিসের জন্য। স্কুলেরহাটের কাছে এসে হাতুড়বাটালের ব্রীজ পার হয়ে মামপি সোজা উত্তরে খড়িবাড়ির দিকে চলতে লাগল। মাজদুল বুঝল মামপি একটুও রাস্তা ভুল করেনি। খড়িবাড়ি পৌঁছে মামপি একটু দাঁড়াল। ঘামে তার গা ভিজে গেছে। খুব টেনশনের মধ্য দিয়ে সে যে এ রাস্তাটুকু এসেছে সেটা ওর চেহারা দেখে আন্দাজ করে মাজদুল। খড়িবাড়িতে তখনও হোটেল খোলা আছে। মামপিকে গাড়িতে বেঁধে হোটেল থেকে পরোটা আর বুটডাল নিয়ে আসে মাজদুল। চালের খুদ আর ছোলাবুট রাতের খাবারের জন্য রেখে দেয়। মামপিকে খাইয়ে নিজে একটা বিড়ি টেনে আবার বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় মাজদুল। পরের দিন মাজদুল জানতে পারে কেন মামপি এতটা পথ ঘুরে এসেছে। নেওয়াশি বাজারের পাশে ঘজ্জেটারির রাস্তায় যে একটা বড় গর্ত হয়েছে সেটা ওর জানা ছিল না। মামপি কেমন করে এ খবর পেল সে কথা ভেবে মাজদুল অবাক হয়ে যায়।

আগের ঘোড়াটা দুর্বল হয়ে গেলে বেশ চিন্তায় পড়েছিল মাজদুল। ওটা বিক্রি করতে গেলে তত দাম বলে না কেউ। গাড়ি টানতে শক্তিমান ঘোড়া লাগে। দশ হাজার টাকার বেশি কেউ দাম বলে না। একটা খোড়া ফকিরের কাছে সাড়ে এগারো হাজার টাকায় ওটাকে বিক্রি করে মাজদুল। বাঁশের খামে জমিয়ে রাখা সাড়ে তিন হাজার মিলে পনেরো হাজার টাকা নিয়ে ঘোড়া কেনার জন্য হাট ঘুরতে লাগল সে। ভালো ঘোড়া পেতে কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকার প্রয়োজন। পনেরো হাজারে ভালো ঘোড়ার পিঠে হাত দিতে পারে না মাজদুল। ওকে ঘুরতে দেখে একজন লোক বলে,
‘ভাই, এদিকে আসো বিড়ি খাই।’
‘বিড়ি খেয়ে কি হবে। চিন্তা করে মাথায় বিষ ধরি গেল।’
‘কতর মধ্যে ঘোড়া কিনতে চান?’
‘তবিল মোটে পনের হাজার।’
‘আমার একটা ঘোড়া আছে। মন করলে দেখতে পারেন।’
‘বাড়ি কোথায় ?’
‘বলদিয়া।’
‘অতদূর যেতে পারব না।’
‘বলদিয়ার হাট যান নাই?’
‘কোন দিকে যেন ? রাস্তা চিনি না।’
‘বলদিয়ায় আফজাল নাম জিজ্ঞেস করবেন। বাচ্চা ছেলেও বলতে পারবে।’

লোকটার কথা শুনে মাজদুল বলদিয়া যায়। ঘোড়া দেখে ওর একটা কথা খেয়াল হয়। এ বাড়ির লোক ওর দিয়ে খেয়াল দেয়নি। কেমন যেন উসকোখুসকো হয়ে পড়েছে চেহারা। চোখ বসে বসে গেছে। সেই চোখে কান্না কান্না ভাব। মাজদুলকে দেখে গা ঘেষে দাঁড়ায় ঘোড়াটা। মাজদুল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ওর মলিন বিষণ্ন চেহারা দেখে মনে দয়া হয় তার। তবু সে ওকে খুটে খুটে পরীক্ষা করে। গাদা থেকে খড় এনে ওর মুখের সামনে দেয়। খড় পেয়ে হাবুসতাবুস করে খেতে থাকে ও। একটা বোঝটানা ঘোড়ার সব ধরণের গুনাগুন পরখ করে মাজদুল বলে,
‘এ ঘোড়া তো নেয়া চলে না।’
‘কি সমস্যা বলবেন তো।’
‘মনে হয় ভালো করে খেতে দেন নি।’
‘একা মানুষ। স্ত্রীও অসুস্থ। ওকে কে খেতে দেবে।’
‘এই ঘোড়া বোঝা টানতে পারবে?’
‘খাওয়ালে বেশ পারবে।’
‘দাম কত নিবেন?’
‘কত দিবেন বলেন?’
‘দশ হাজার।’
‘পাগল হয়েছেন। দশ হাজারে কিনতে পারবেন?’
‘তাহলে ফেরত যেতে হবে।’
‘ঘোড়া কেনার ইচ্ছে থাকলে বিবেক মতো কথা বলেন। অত কমে হবে না।’

দু’জনে বেশ কথা হয়। অবশেষে এগার হাজার টাকা দাম চুড়ান্ত হয়। দুপুরের খাবার আফজালের বাড়িতে খেয়ে ঘোড়া নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয় মাজদুল। মামপি নামটা সে পথ চলতে চলতেই খেয়াল করে। বলদিয়া বাজারে ট্রলি ভাড়া করে ওর সাথে গল্প করতে করতে সে বাড়ির দিকে চলে আসে। চলার পথের সব হাটবাজার, রাস্তাঘাট সে মামপিকে চিনিয়ে দেয়। বাড়ি এসেই মামপির চিকিৎসার দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠে মাজদুল। বাজার থেকে কৃমির ঔষধ এবং দামী ভিটামিন এনে খাবারের সাথে মিশ্রিত করে খাওয়াতে থাকে। তার সাথে রুচিবর্ধক এবং পেট পরিষ্কারক ঔষধও সে ব্যবস্থা করে। অল্প দিনের মধ্যে মামপির চেহারায় পরিবর্তন দেখা দেয়। ওর মনে বেশ উৎফুল্লতা আসে। মাজদুলের প্রতিটি কথায় সে সাড়া দিতে থাকে। মাজদুলও ওকে নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। গ্রামের সবাই বলেছিল এ ঘোড়া কিনে সে বিস্তর লোকসানে পড়বে। কিন্তু মাজদুলের ধারণাই সফল হল। একটা বোঝাই টানা যুতসই ঘোড়া কিনতে তার কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগত। সেখানে সে মাত্র এগার হাজারে মামপির মতো একটা সুন্দর ঘোড়া পেয়েছে। প্রথম যেদিন ওকে নিয়ে মাজদুল ভাড়া ফেলতে যায় সেদিন ছিল শনিবার। গ্রামেরই এক লোক মেয়ের বিয়ে দিয়েছে গজেরকুটির উত্তরে। মেয়ের বাড়িতে কিছু আসবাবপত্র নিয়ে যেতে হবে। প্রতিবেশির সাথে তো দামদর চলে না। লোকটা ইচ্ছে করেই দু’শ টাকা পকেটে গুজে দিল। আল্লাহর নাম ইয়াদ করে বাবামা পীর মুর্শেদের দোয়া নিয়ে মাজদুল মামপির ঘাড়ে গাড়ির পাগা তুলে দিল। গজেরকুটির রাস্তায় উঠে মামপির পিঠে একবার বেতের ছোঁয়াও দিতে হল না তাকে। আপনমনে হেঁটে অল্প সময়ের মধ্যে সে মনজিলে পৌঁছে গেল। ওরা আবার মাজদুলকে না খেয়ে আসতে দেবে না। প্রতিবেশির বিয়াইন সাহেবা মামপিকে থালা ভর্তি পিঠা পায়েশ মুড়ি মুড়কি খেতে দিয়ে তামাশা দেখতে লাগল। মাজদুল খেল নতুন বিয়াইর বাড়িতে। ভালোই লাগল তার। ফেরার সময় ওর পকেটে ঢুকল পথখরচার সম্মানী। মামপির সাথে গল্প করে বালারহাটে এসে পান খেয়ে বিড়ি টানল মাজদুল। মামপির মুখেও একটা খিলিপান ঠেলে দিল সে। প্রথম দিনটা ভালোই কাটল দু’জনের। বাড়ি এসে মাজদুল মামপিকে নিয়ে গেল নতুন চরে। সেখানে তিন কিতা জমিতে মাসকলাই বুনেছে সে। খেতের মধ্যে গজিয়ে ওঠা চামদুবলা বেশ লকলকিয়ে বাড়ছে। সেই দুবলা টেনে মামপিকে খাওয়ায় সে। বিকেলে দুই বোঝা দুবলা ওর পিঠে চেপে গান গেয়ে বাড়ি ফেরে সে।

এভাবে মামপির সাথে গভীর সখ্যতা সৃষ্টি হয় মাজদুলের। মামপির সুখের জন্য সব ধরণের যত্ন নেয় সে। অনেক রাত জেগে সে ওর থাকার ঘরের মশা তাড়ায়। হাতের আন্দাজে ওর লোমের ভেতর থেকে উকুন এবং আটাল খুঁজে বের করে আগুনে পুড়ে মারে। মাজদুল লক্ষ্য করে কয়েল জ্বালিয়ে খুব একটা মশা নিপাত হয় না। মশার কামড়ে সারারাত মামপি ছটফট করে থাকে। একটুও ঘুম হয় না ওর। সেজন্য বাজার থেকে লায়লন নেট কিনে ভালো দর্জির নিকট থেকে একখানা মশারি বানিয়ে আনে সে। মশারির ভেতর আরামে রাত কাটায় মামপি। অবোধ পশুও নিজের আরাম বোঝে। মাজদুলের গা চেটে দিয়ে ওকে ধন্যবাদ জানায় মামপি। মাজদুলের যত্ন এবং আন্তরিকতায় অল্প কিছুদিনের মধ্যে মামপির স্বাস্থ্যের দারুণ উন্নতি ঘটে। এখন এক ডাকে সবাই ওর দাম চল্লিশ হাজার টাকা দিতে চায়। ওর দেহের লাবণ্য এবং উজ্জ্বলতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ওকে পেয়ে মাজদুল খুব খুশি। অতি আনন্দে দিন কাটে তার। এখন মামপি অনায়াসে বিশ মন ভার নিয়ে সবেগে চলতে পারে। এখন আগের মতো খাবারও লাগেনা তার। অল্প খেয়েই ও বেশ পুষ্ট এবং সতেজ হয়ে উঠছে।

বৈশাখের শুরুতেই এবার মেঘের ঘনঘটা । গরমও পড়ছে । গরমে মামপি কাতর হয়ে পড়ে। সেজন্য ওকে নিয়ে দূরের হাটে যেতে চায় না মাজদুল। বেশি মালও নেয় না সে গাড়িতে। মামপিকে আরাম দিয়ে যতটুকু রোজগার হয় তাই যথেষ্ট। কিন্তু মানুষের পীড়াপীড়ি কতটুকু এড়িয়ে চলা যায়। এক আধটু দূরের ভাড়ায়ও তো যেতে হয়। তাই ভালো দিন দেখে একটা দূরের ভাড়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল মাজদুল। উলিপুরের হাট তার কোনদিন যাওয়া হয়নি। ধরলা ব্রীজ দিয়ে ঘুরে যেতে হবে তাকে। হঠাৎ যদি আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামে তাহলে ঝামেলা হবে। মন পনেরক তামাকের ভাড়া নিয়ে সে উলিপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তীব্র রোদের কারণে পথে যাত্রা বিরতি করে বার তিনেক বিশ্রাম দিতে হয়েছে মামপিকে। ফাঁকা জায়গায় একটা বটগাছের ছায়ায় জিরিয়ে মামপিকে বিলের স্বচ্ছ পানিতে গোসলও করিয়েছে সে। খাবার সাথেই ছিল। মামপিকে ঝোলাগুড় আর মাসকলাইয়ের ভুষি খাইয়ে বিকেলের আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যায় মাজদুল। মহাজনের আড়তে মাল খালাস করে ভাড়ার টাকা পেতে তার কিছুটা দেরিই হয়। এর মাঝেই মেঘ ঝাঁপিয়ে নামে তুমুল বৃষ্টি। সে বৃষ্টি আর থামতে চায় না। রাত বেড়ে গেলেও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি চলতেই লাগল। মামপিকে দোকানের পরোটা সবজি খাইয়ে বাড়ির দিকে রওনা করল মাজদুল। গাড়ির জুয়ায় হ্যারিকেন বেঁধে মাবুদের নাম স্মরণ করে মামপিকে চলতে নির্দেশ দিল সে। চারদিকে আঁধার নেমেছে। পৃথিবী নামের গ্রহ অচেনা লাগছে মাজদুলের কাছে। কোন পথে সে এসেছে আর কোন পথে ফিরে যাবে কিছুই আন্দাজ করতে পারেনা মাজদুল। তবু এক মুরুব্বীর কাছে পথের ধারণা নিয়ে গাড়ী হাঁকায় সে। শুধু একটা কথা মামপিকে বলে, ‘যে পথে এসেছ সেই পথ ধরে দ্রুত চলতে থাক। একটুও এদিক ওদিক যাবে না।’

মাজদুলের নির্দেশ পেয়ে দুর্বার গতিতে অন্ধকারের ভেতর ঢুকে গেল মামপি। খুড়ের আওয়াজে পথপার্শের গাছপালায় মৃদ্যু প্রতিধ্বনি তুলে সে চলতে লাগল বাড়ির দিকে। মামপিকে নির্দেশ দেয়ার কোন ক্ষমতা মাজদুলের নেই। ওর ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোন উপায় নেই তার। একটানা চলে পাঁচপীর হিংগুন রায় এবং কুড়িগ্রাম শহরকে পশ্চাতে ফেলে ধরলা ব্রীজের কাছে এসে দাঁড়ায় মামপি। এতক্ষণে মাজদুল বুঝতে পারে মামপি রাস্তা ভুল করেনি মোটেই। ব্রীজের কাছে মামপির দাঁড়ানোর নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে। ব্রীজে কোন লোকজন নেই। এত রাতে একটি গাড়িও পার হচ্ছে না। কিছুটা সময় জিরিয়ে তুমুল বেগে সে চলতে লাগল। হঠাৎ করে তিনজন লোক ছুটতে লাগল গাড়ির পেছনে। কিন্তু মামপির গতির কাছে হার মানতে হল তাদের। পাটেশ্বরী বাজার পর্যন্ত একই গতিতে চলতে লাগল মামপি। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে শক্ত হয়ে গাড়িতে বসে থাকল মাজদুল। বেপারীর হাটের কাছে বামে মোড় নিয়ে ডুঙ্গডুঙ্গি খোলারহাট হয়ে মামপি পৌঁছে গেল খড়িবাড়ির বাজারে। পাগলার চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল মামপি। মামপির গা ঘেমে পানি চুইয়ে পড়ছে। লাগাম ধরে ওর শরীরে বাতাস দিল মাজদুল। গামছা ভিজিয়ে ওর শরীরের ঘাম মুছে দিল। দোকান থেকে পরোটা এবং মিষ্টি এনে আদর করে ওকে খাইয়ে দিল। মামপির স্মরণশক্তি দেখে বড় অবাক হয় মাজদুল। আনন্দে বুক ফুলে ওঠে তার। সত্যিকারের এক বন্ধু পেয়েছে সে। যে কোন পরিস্থিতিতে তাকে সাহায্য করার মতো এক নির্লোভ সাথীর সন্ধান পেয়ে সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। পাগলার দোকানে এক কাপ চা খেয়ে সে গুনগুন করে গান গেয়ে বাড়ির দিকে চলতে থাকে।

মামপির মুখে একটা মিষ্টি পান দিতে সে একটুও ভুল কওে না মাজদুল।

তমসুর হোসেন
কবি ও গল্পকার।
সরকার মঞ্জিল, কলেজ রোড।
ফুলবাড়ি, কুড়িগ্রাম।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল rajdhanitimes24.com এ লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয়- মতামত, সাহিত্য, ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার ছবিসহ লেখাটি পাঠিয়ে দিন rajdhanitimes24@gmail.com  এই ঠিকানায়।

শীর্ষ সংবাদ:
এতিমখানার অনুদান থেকে সমাজসেবা কর্মকর্তার ঘুষের ভিডিও ভাইরাল বৃষ্টির জন্য মোনাজাতে মুসল্লিদের অঝোরে কান্না ১৭ ঘন্টা পর নিখোঁজ শ্রমিকের লাশ উদ্ধার কেন্দ্রের নির্দেশে গোয়ালন্দে বিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন উপাচার্যের অপসারণ চেয়ে এক দফা দাবি কুবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের মাঠে অনড় থাকায় বহিষ্কার হলেন ইউনিয়ন বিএনপির আহবায়ক এপ্রিলের ২৬ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬৮ কোটি ডলার রোববার থেকে ফের তিন দিনের হিট অ্যালাট জার্রি! শ্রীনগরে বৃষ্টির জন্য ইসতেস্কার নামাজ আদায় গোয়ালন্দ বাজারে উপজেলা ছাত্রলীগের শরবত বিতরণ বাকৃবির সেরা ৫ গবেষককে অ্যাওয়ার্ড প্রদান হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু গোয়ালন্দে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসুল্লিরা মতলবে বৃষ্টির জন্য ইস্তিসকা নামাজ আদায় দেশের সর্বোচ্চ ৪২.৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পুড়ছে চুয়াডাঙ্গা লালমোহনে রহমতের বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে তাকালে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ শরিফ দীর্ঘ তাপপ্রবাহে রেকর্ড, কতদিন থাকবে জানাল অধিদপ্তর বৃষ্টি চেয়ে রানীশংকৈলে ‘ইসতিসকার’ নামাজে মুসল্লিদের বিশেষ দোয়া গাজীপুরে তাপদাহে ঝরছে লিচুর গুটি, দিশেহারা চাষিরা