রাজশাহীর মূর্তমান আতঙ্ক ছিল ছাত্রলীগ নেতা রকি কুমার ঘোষ

জমি দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক, দেহ ব্যবসা, নিয়োগ বাণিজ্য, সুদের ব্যবসা করে অঢেল সম্পদ

0

রাজশাহী মহানগরীতে মূর্তমান আতঙ্কের নাম ছিল রকি কুমার ঘোষ। পদে ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিলেও ২০১২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর রাজনীতিতে দমন, নিপিড়ন, নির্যাতনের প্রধান হোতা ছিল রকি কুমার ঘোষ।

ক্ষমতার দাপটে সাধারণ মানুষের জমি দখল, মাদকের কারবার, বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, নারী দিয়ে দেহ ব্যবসা, নিয়োগ বাণিজ্য, উচ্চহারে সুদের ব্যবসা, সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা রকি কুমার ঘোষ করে নি। রকিকে বলা হতো সন্ত্রাসীদের গড ফাদার। অপকর্ম করে তিনি কামিয়েছেন অঢেল সম্পদ।

গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্যান্য নেতাদের সাথে রকিও পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বিভিন্ন থানায় প্রায় ৫টি মামলা হয়েছে। সূত্র বলছে, রকি রাজশাহীর মধ্যেই রয়েছে। তিনি রাজশাহীর বেশ কিছু লোকজনের সাথে যোগাযোগ করছেন। এমন কি কিছু আওয়ামী লীগপন্থী সাংবাদিকের সাথেও তার যোগাযোগ রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছে রকি ভারতে পালিয়ে গেছে।

জানা গেছে, ২০১২ সাল থেকে রকি কুমার ঘোষ রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। প্রথম দিকে সাবেক রাসিক মেয়র লিটনের কাছে ঘেঁষতে তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দদের সাথে তিনি লবিংগ্রুবিং শুরু করেন। এক সময় লিটনের চোখে পড়ে রকি। এরপর থেকে রকি সাবেক মেয়র লিটনের খুব কাছের একজন হয়ে কাজ করেন। ২০১৩ সালে রাসিক নির্বাচনে লিটনের পক্ষে ব্যাপক কাজ করে আলোচিত হয় রকি। যদিও এই নির্বাচনে সাবেক মেয়র লিটনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন নগরবাসী। এ নির্বাচনে বিপুল ভোটে হেরে যান লিটন। মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল।

সাবেক মেয়র লিটন ও তার মেয়ে অর্না জামানের আস্থাভাজন হওয়ায় ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর রকি কুমার ঘোষকে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শুধু মাত্র সাবেক মেয়র লিটন ও তার মেয়ে অর্না জামানের কারণে তিনি সভাপতির মত একটি গুরুত্বপুর্ন পদ পান। এই পদ পাওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মাথার উপর সাবেক মেয়র ও তার মেয়ের হাত থাকায় তিনি হয়ে উঠেন রাজশাহীর মূর্তমান আতঙ্ক। শুরু করেন টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, অন্যের জমি দখল করে প্লট ও মাদকের ব্যবসা।

জানা যায়, র‌্যাব-৭ কক্সবাজার কলাতলী এলাকা থেকে রাজশাহীর শীর্ষ মাদক কারবারী আসলাম সরকারকে আটক করে। তার মাইক্রোবাস থেকে ১ লাখ ৮ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়। আসলাম সরকার ইয়াবাসহ আটক হলেও পেছনের কারিগর ছিল রকি কুমার ঘোষ। রাজশাহী নগরীর ঘোষপাড়ায় অবস্থিত আসলাম সরকারের ব্ল্যাক ক্যাফের আড়ালে চলতো মাদক ও দেহ ব্যবসা। এ কারবারের সেল্টার ও সহযোগি ছিলেন রকি। আসলাম সরকারের সাথে মাদক ও তরুণ-তরুণীদের দিয়ে দেহ ব্যবসা টাকা অর্ধেক হিসাবে ভাগ নিতেন রকি। ২০২৩ সালে রকি স্বেচ্ছাসেব লীগের পদপ্রত্যাশী হলে রকি ও আসলাম সরকারের ছবি সম্বলিত ব্যানার টাঙানো হলে আলোচনার ঝড় উঠে। প্রকাশ হয়ে যায় তাদের দুজনের অবৈধ ব্যবসার রহস্য।

জানা গেছে, রকি কুমার ঘোষ ইচ্ছা মানবিক উন্নায়ন সংস্থা খোলেন। ঋণ কার্যাক্রমের লাইসেন্স না থাকলেও তিনি এনজিও’র মত উচ্চ সুদে ঋণ বিতরণ করেন। অফিস নেন নগরীর দাসপুকুর মোড়ে। এলাকায় বেশ কয়েকজনকে এ ব্যবসায় শেয়ারদার হিসাবে নেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষদের উচ্চ সুদে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ঋণ দিতেন তিনি। কোনো ব্যক্তি সুদের টাকা দিতে না পারলে তার উপর চলতো নির্যাতন, অত্যাচার। অনেক সাধারণ মানুষের বাড়ি থেকে জোর করে গরু ছাগল নিয়ে বিক্রি করে সুদের টাকা তুলেছেন রকি। এমন কি আসল টাকা দেয়ার পর সুদ দিতে না পারায় অনেকেই বাড়ি ছাড়া হতে হয়েছে। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে।

এক সময় রকি সব টাকা হাতিয়ে হাতিয়ে নিয়ে এনজিও বন্ধ করে দেন। এছাড়াও তিনি স্বপ্নের রাজশাহী নামে একটি সমিতি করেন। সমিতির সদস্য ছিল অন্তত ৮০জন। প্রতিজন মাসিক ৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা সমিতিতে জমা করতেন। চার বছর পর এই সমিতি ভেঙ্গে টাকা ভাগ বাটোয়ারা করার কথা ছিল। কিন্তু রকি শেষ সময়ে এসে নিজেই ওই সমিতির টাকা তুলে নাপাত্তা হয়ে যান। কারণ সমিতির মূল একাউন্ড ছিল রকির নামে। এই সমিতির মাধ্যমে রকি হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৬ কোটি টাকা। রকির কারণে সর্বশান্ত হয়েছে অনেক পরিবার।
এদিকে, জমি দখল, দখলের পর বিক্রি করা ছিল রকির প্রধান ব্যবসা।

তিনি ক্যাডার বাহিনী দিয়ে লোকজনের জমি যেমন দখল করে দিতো, তেমনি নিজেও দখল করে নিতো। যেখানেই জমির জটিলতা, সেখানেই রকি বাহিনীর তান্ডব। তিনি হিন্দু সম্প্রদয়ের হওয়ার পরও তার ক্যাডারা বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পায়নি হিন্দুধর্মালম্বীদেরও জায়গা জমি। মজার বিষয় হলো রকির স্ত্রীর রয়েছে একশ ভরি স্বর্ণের গহনা। যা তিনি বিভিন্ন সময় উপহার দিয়েছেন।
জানা যায়, সাবেক রাসিক মেয়র লিটনের ইন্ধনে ২০১৮সালের ২২ মে নগরীর সাহেববাজার এলাকায় ফুটওভার ব্রিজে টাঙানো মেয়র বুলবুলের ব্যানার সরিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের একটি ব্যানার টাঙিয়ে দেয় রকি। এর প্রতিবাদে মেয়র বুলবুল সেখানে কর্মসূচি পালন করে। প্রায় এক দশক ধরে রকি বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী সমর্থকদের উপর দমন নিপিড়ন চালিয়েছে। শিক্ষার্থীদের শিবির আখ্যা দিয়ে কখনো পুলিশে দিয়েছে আবার কখনো মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে রাসিক নির্বাচনে রকি মেয়র প্রার্থী লিটনের পক্ষে ৫০ হাজার জাল ভোট দিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে কেন্দ্র সরবরাহ করে। পরে বিষয়টি প্রকাশ হলেও সেটি ধামাচাপা পড়ে যায়।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, ঘোষপাড়া মোড়ে রকির ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অফিস ছিল। স্থানীয়দের ভাষায় সেটি অফিস ছিল না, ছিল টর্চার সেল ও মাদকের আড্ডাখানা। প্রতিরাত সেখানে জুয়ার সাথে মাদকের আড্ডা বসতো। আর সখোনেই সাধারণ লোকজন, ব্যবসায়ীদের ধরে এসে টর্চার সেলে নির্যাতন চালানো হতো। এক সময় ওই এলাকার লোকজন মুখ খুলতে না পারলেও এখন তা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। স্থানীয়রা বলছেন, রাত হলেই রকির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে ভেসে আসতো টর্চার সেলে নির্যাতিতদের আত্মচিৎকার। ভয়ে কেউ তার অফিসের দিকে তাকানোর সাহস করতো না।

বিষয়টি নিয়ে নগরীর বোয়ালিয়া মডে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেহেদি মাসুম বলেন, শুধু রকি কুমার ঘোষ নয় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সর্বদাই চেষ্টা করছে। তারা আত্মগোপনে থাকার কারণে আটক করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর