কুমিল্লার লাকসামের সিংহপুরুষ, উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি, সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি হুমায়ূন কবীর পারভেজ গুমের দীর্ঘ ১১ বছর অতিবাহিত হয়ে প্রায় ১ যুগ হতে চলছে, নেই কোনো খবর পায়নি পরিবার। এ ২ নেতা বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন এই তথ্যটুকুও জানেন না পরিবার তারা।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সম্প্রতি কয়েকজনের ফিরে আসার খবরে আশাবাদী হিরু- হুমায়ুনের পরিবার ছোটা-ছুটি করছেন তাদের ফিরে পাওয়ার আশায়। যাচ্ছেন বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্থার দ্বারে দ্বারে। কিন্তু পাচ্ছে না কোনো সুফল।
পরিবার ও মামলা সূত্রে জানা যায় , ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাতে কুমিল্লার হরিশ্চর এলাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে কয়েকজন ঢাকাগামী অ্যাম্বুলেন্স থেকে সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু, বিএনপি নেতা হুমায়ূন কবির পারভেজ ও পৌর বিএনপি নেতা জসিম উদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায়। পরে তারা জসিমকে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকায় অন্য একটি মাইক্রোবাসে তুলে দেন। সাবেক এমপি হিরু ও বিএনপি নেতা পারভেজকে নিয়ে যান তারা। এরপর থেকে বিএনপির ওই দুই নেতা নিখোঁজ রয়েছেন।
পরে হিরুর পরিবার লাকসাম থানায় গেলে মামলা নেয়নি পুলিশ। বাধ্য হয়ে নিখোঁজ ডায়েরি করেন তারা। তবে তাতে কোনো লাভ হয়নি।
পরে, ২০১৪ সালের ১৮ মে হুমায়ূন কবির পারভেজের বাবা রংগু মিয়া বাদী হয়ে কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে মামলা করেন। মামলায় র্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত প্রধান কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, কোম্পানি অধিনায়ক মেজর সাহেদ রাজী, ডিএডি শাহজাহান আলী, এসআই সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমারকে আসামি করা হয়।
ওই বছরের ৩১ আগস্ট মামলার বাদী রংগু মিয়া মারা যান। সে কারণে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর পারভেজের ছোট ভাই গোলাম ফারুককে এ মামলার বাদী করা হয়। ২০১৫ সালে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহম্মদ ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। এতে র্যাব কর্তৃক দুজনকে ‘অপহরণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি’ বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে দুই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে থাকতে পারেন বলে উল্লেখ করা হয়।
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী বদিউল আলম সুজন বলেন, পুলিশের তদন্তের পর সিআইডি সাড়ে ৫ বছরে অন্তত ৬৩ বার আদালত থেকে সময় নিয়ে একটি মনগড়া ও মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছে। পরে বাদীর নারাজির পরিপ্রেক্ষিতে আদালত মামলা পিবিআইতে স্থানান্তর করেন। আমরা আশাবাদী, হিরু-হুমায়ুন গুমের বিচার এ দেশে হবে। এরই মধ্যে আমি বিষয়টি নিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। বাদীপক্ষ থেকে তদন্ত কর্মকর্তাকে সব ধরনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করা হবে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লাকসাম সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সৌমেন মজুমদার বলেন, আমরা মামলাটি প্রায় দেড় বছর ধরে তদন্ত করছি। তবে বিগত সময়ে পরিস্থিতির কারণে বাদীপক্ষ, প্রতক্ষ্যদর্শীসহ কারো তেমন সহযোগিতা পাইনি। পাশাপাশি বারবার চেষ্টা করেও আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। শিগগিরই অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং বাদীপক্ষসহ প্রত্যক্ষদর্শীকে তথ্য দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হবে।
গুম হওয়া সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরুর স্ত্রী ফরিদা ইসলাম হাসি বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর অনেকেই ফিরে এসেছে। আমরাও হিরুর অপেক্ষায় আছি। নতুন সরকারের কাছে আমার স্বামীকে ফেরত চাই।
সাইফুল ইসলাম হিরুর একমাত্র ছেলে রাফসানুল ইসলাম বলেন, বাবার খোঁজ চেয়ে অনেকের দ্বারস্থ হয়েছি। লাকসাম থানা মামলা নেয়নি। পরে কোনো উপায় না পেয়ে বাবা হারিয়ে গেছে মর্মে একটি জিডি করি। সেখান থেকে আমরা যাই র্যাব-১১-এর নারায়ণগঞ্জ অফিসে। র্যাব সেদিন অভিযান চালালেও আমার বাবাকে আটক করেনি বলে জানানো হয়। সেই থেকে যেখানেই বাবার খোঁজ আছে শুনেছি, সেখানেই ছুটে গেছি। এখনও বাবাকে খুঁজছি। আমরা ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে দেখা করেছি, তারা প্রয়োজনীয় কিছু তথ্যপ্রমাণ চেয়েছে, আমরা সব দিয়েছি। আশা করি বাবাকে ফিরে পাব।
বিএনপি নেতা হুমায়ূন কবির পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার বলেন, আমার স্বামীর কী অপরাধ ছিল? বিএনপি করা কী অপরাধ? আমরা প্রিয় মানুষটিকে ফেরত চাই।
হুমায়ুন কবির পারভেজের ছেলে শাহরিয়ার কবির রাতুল বলেন, আশা করছি নতুন সরকারের কাছ থেকে একটি ইতিবাচক খবর পাব। একটি স্বাধীন দেশে প্রকাশ্যে দুটি মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে গুম করা হলো কার নির্দেশে? সেই নেপথ্যের ব্যক্তির নাম লাকসামের মানুষসহ দেশবাসী জানতে চায়।
এদিকে গুম হওয়া সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরুর স্ত্রী ফরিদা ইসলাম হাসি স্বামী শোক সইতে না পেরে অসুস্থ হয়ে হার্ট অ্যাটাক করেন। পরিবারের দাবি হিরুসহ হুমায়ুন কবির পারভেজের সন্ধান চাই এবং গুমের বিচার চাই করেন।