চারদিকে যেনো মৌসুমী ফল কাঁঠালের মৌ মৌ গন্ধ। যেদিকে চোখ যায় শুধু কাঁঠাল আর কাঁঠাল। মহাসড়কের দু’পাশে ভ্যান ভর্তি সাড়ি সাড়ি কাঁঠাল। কোথাও কোথাও আবার বড় বড় কাঁঠালের স্তূপ। পথের পাশে অস্থায়ী কিংবা বাজারের দোকানে সাজানো রসালো এ ফলের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে তা কিনে বাড়ি ফিরছেন পথচারীরাও। দেশের অন্যান্য এলাকার মতো গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রায় সব এলাকায় কাঁঠাল বাগান রয়েছে। এ এলাকার প্রায় ৯৫ শতাংশ বাড়িতে জাতীয় ফল কাঁঠালের ফলন হয়। এ জন্য গাজীপুরকে ‘কাঁঠালের রাজধানী’ বলা হয়। দেশের সবচেয়ে বড় কাঁঠালের বাজারও গাজীপুরের শ্রীপুরে।
শ্রীপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর গড়ে ৭৮ হাজার মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলনও হয়েছে বেশি। ন্যায্য দাম পেয়ে খুশি কৃষক ও বিক্রেতারা। এ অবস্থা মৌসুমের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদ তাদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জৈনাবাজারে বসে দেশের সর্ববৃহৎ কাঁঠালের বাজার। মৌসুমের প্রতিদিনই এ বাজারে বিক্রি হয় হাজার হাজার কাঁঠাল। দিনে-রাতে প্রায় সব সময়ই চলে এ বেচাকেনা। তবে জমজমাট থাকে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা আসেন উপজেলার জৈনাবাজারের কাঁঠালের হাটে। কাঁঠাল নিয়ে যান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। আর বাগান থেকে বাজারে আনা, কেনাবেচা, গাড়িতে ওঠা-নামা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন শত শত লোক।
রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পাইকারদের থাকা-খাওয়ার অবকাঠামোগত সুবিধার কারণে জৈনাবাজার হয়ে উঠেছে কাঁঠালের সবচেয়ে বড় বাজার। উপজেলার জৈনাবাজার, মাওনা বাজার, এমসি বাজার, বানিয়ারচালা ও ভবানীপুর বাজারেও প্রতিদিন কাঁঠালের বাজার বসে। মধুমাস জ্যৈষ্ঠের শুরু থেকে এ চিত্র চলবে আষাঢ় মাসের শেষ পর্যন্ত। এ বাজারের কাঁঠালের মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। গাছ থেকে কাঁঠাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রীপুরের কাঁঠাল বাগান মালিকেরা।
গাছ থেকে কাঁঠাল সংগ্রহ করে বাজারজাত করার জন্য বাড়ির পুরুষদের পাশাপাশি ব্যস্ত নারীরাও। প্রতিদিন ভোরে বাগান থেকে পাকা কাঁঠাল সংগ্রহ করে পুরুষরা তা বিক্রির জন্য ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, টমটম, অটোরিকশায় করে নিয়ে আসেন বাজারে।
শ্রীপুরের মাওনা উত্তর পাড়া এলাকার রেজাউল এক বাগান মালিক বলেন, ‘এখানকার কাঁঠাল মিষ্টি, সুস্বাদু ও স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় হওয়ায় স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হয়।
তিনি আরও জানান, তার বাড়ির পাশে বাগানে ৩০০টিরও বেশি গাছ রয়েছে। গাছে মুচি আসার সময় খড়া থাকায় বেশ কয়েক বছরের মতো এবারও কাঁঠাল কম ধরেছে। তবে দাম মোটামুটি ভালো থাকায় সেই ক্ষতি পুষিয়ে যাবে। ‘প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ টাকার কাঁঠাল বিক্রি করি। এবারও বেশ ভালো বিক্রি হবে আশা করছি।
সিলেট থেকে আসা পাইকারী ব্যবসায়ী কালাম মিয়া জানান, সিলেটের গোবিন্দগঞ্জে তার কাঁঠলের আড়ৎ আছে। সিলেটে খুব চাহিদা থাকায় প্রতিবছরই এখান থেকে কাঁঠাল নিতে আসেন তিনি। বললেন, প্রতি কাঁঠালে ২০-৩০ টাকা লাভ হয়। স্থানীয় খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছেও তা বিক্রি করি। মৌসুমী এ বাজারে অনেকের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়েছে। অল্প পুঁজি কিংবা অন্যের পুঁজি দিয়ে শুধু শ্রম দিয়েও অনেকে ব্যবসা করছেন ওই বাজারে। তাদেরই একজন জৈনাবাজারের আড়তদার আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পাইকারদের কাঁঠাল কিনে দিই। প্রতি ট্রাকে আমি পাই ৩ হাজার টাকা। নিজের কোনো পুঁজি লাগে না।
শুধু খালেকই নন, এভাবে আরও অনেকেই সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, বরিশাল ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জৈনাবাজারে কাঁঠাল কিনতে আসা পাইকারদের ট্রাক ভর্তি কাঁঠাল কিনে দিচ্ছেন প্রতিদিন। প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ ট্রাক দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই বাজার থেকে যায় বলে জানালেন খালেক।
জৈনা বাজারের পুরাতন আড়তদার ইসলাম উদ্দীন মেম্বার বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে এখানে আড়তদারি করি। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাঁঠালের জন্য পাইকাররা আসেন। কম দামে ভালো মানের কাঁঠাল পাওয়া যায় এই ঐতিহ্যবাহী হাটে।
শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমাইয়া সুলতানা বন্যা বলেন, ‘কাঁঠাল পুষ্টিগুণে ভরপুর। স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। এ বছর প্রচুর কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে শ্রীপুরের কাঁঠাল বিদেশেও পাঠানো হচ্ছে। প্রতিদিন জৈনাবাজার থেকে পাইকারদের হাত হয়ে শ্রীপুরের কাঁঠাল যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।আমরা কাঁঠাল চাষে আগ্রহ বাড়াতে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছি।