ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সরকারি সাত কলেজের ৭ সমস্যার সমাধান সাত বছরেও দিতে পারেনি ঢাবি ও সাত কলেজ প্রশাসন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) সেশনজট দূর করতে সাত কলেজের সেশন ৮ মাসে করেছে। তবে পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৭-৮ মাসের বেশি সময় পার হলেও এখনো সাত কলেজের বিভিন্ন সেশনের অনেক বিভাগের অফিসিয়ালি ফল প্রকাশিত হয়নি।
মূলত বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক না থাকা, রেষারেষি, অন্তর্কোন্দলসহ ফল জমাদানে অনীহা ও উদাসীনতার কারণই হলো এর অন্যতম প্রধান সমস্যা। ২০১৯ সনের ডিগ্রী তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়ে পার হয়ে গেছে ৬ মাসেরও বেশি সময়। কিন্তু এখনও অনেক ডিপার্টমেন্টের রেজাল্ট প্রকাশ হয়নি। অনার্স (১৮-১৯,১৯-২০) সেশনের তৃতীয় এবং দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়ে (৭ থেকে ৮মাসের) অধিক সময় পার হলেও এখন বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের রেজাল্ট প্রকাশিত হয়নি।
এছাড়াও আনার্স (২০-২১) সেশনের পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৩-৪ মাসের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত একটি বিভাগেরও ফলাফল প্রকাশ হয়নি। যার ফলে বোঝা যাচ্ছে বিভাগের শিক্ষকদের সমন্বয়হীনতার কারণে ফল প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে শিক্ষকদের বিভক্তি, বিভাগের প্রাপ্য সুবিধাদি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান বহির্ভূত কাজে বেশি সময় দেওয়ায় এমনটা হচ্ছে। এছাড়া খাতা মূল্যায়ন করে সঠিক সময় জমা না পাওয়া এবং রেজাল্টে পার্থক্য হওয়ায় খাতা মূল্যায়ন করতে দেরি হওয়ায় ফল তৈরি করতে বিলম্ব হচ্ছে।
অনেক শিক্ষার্থী স্নাতক শেষে চাকরির আবেদন কিংবা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যেতে আগ্রহী। ফল প্রকাশ না হওয়ায় তারা এসব কিছু করতে পারছেন না। ফলে হতাশ হয়ে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। অনেকে আবার স্নাতকোত্তরের জন্য অন্যত্র ভর্তি হতে ইচ্ছুক হলেও ফল প্রকাশ না হওয়ায় তাও পারছেন না।
অনার্স (২০১৬-১৭) সেশনের ইংরেজি সহ আরো (১৩-১৪) বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষ (বিশেষ) ২০২১ সনের পরীক্ষা শেষ হয়েছে ডিসেম্বর ২০২২ সালে। তবে ৪ থেকে ৫ মাস রানিং কিন্তু এখনো রেজাল্ট পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। যার কারণে বিভিন্ন চাকরির আবেদন করতে পারছে না,ফলে শিক্ষার্থীরা চরম হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে।
এদিকে (২০-২১) সেশনের ১ম বর্ষের ফলাফল প্রকাশ না হওয়ার আগেই দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। প্রায় সব ক্যাম্পাসেই অনার্স ২য় বর্ষ (২০-২১) শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ইনকোর্স পরীক্ষা শুরু হয়েছে। যার কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েছ শিক্ষার্থীরা। বেশীর ভাগ শিক্ষার্থীদের মতামত ১ম বর্ষের রেজাল্ট না দিয়ে ২য় বর্ষের পরীক্ষার নোটিশ দেওয়া অযৌক্তিক। তাদের দাবি রেজাল্ট দেওয়ার পর শর্ত পূরণ না হওয়ার কারণে অনেকে হয়তো পরবর্তী ইয়ারের জন্য প্রমোট পাবে না, আবার অনেকের ইমপ্রুভ থেকে যাবে। এখন পরীক্ষার জন্য সবাই বই কিনে পড়ে ইনকোর্স এক্সাম দিবে। তবে কিছুদিন পর যখন ১ম বর্ষের রেজাল্ট দিবে, অনেকে যখন দেখবে প্রমোট পাই নি তখন কি হবে? এসবের কারণে তারা চরম হতাশায় ভুগছেন।
সাত কলেজের সাত সমস্যা হলোঃ
১। পরীক্ষা সমাপ্তের ৩ মাসের মধ্যে সকল বিভাগের প্রকাশে ব্যর্থ প্রশাসন।
২। লিখিত পরীক্ষা সমাপ্তের ৩০ দিনের মধ্যে ব্যবহারিক এবং মৌখিক পরীক্ষা শেষ করতে ব্যর্থ কতৃপক্ষ।
৩। পুনঃ নীরিক্ষার ফলাফল আবেদন করার ১ মাসের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করতে ব্যর্থ প্রশাসন।
৪। একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করতে ব্যর্থ প্রশাসন। একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পরীক্ষা আয়োজন এবং ফলাফল প্রকাশে ব্যর্থ বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ।
৫। ফলাফল সমন্বয়ে জটিলতা। দীর্ঘ সময়ে ফলাফল সমন্বয় সমাধানে ব্যর্থ প্রশাসন।
৬। সমস্যা সমাধানের জন্য কলেজে সেল গঠনে ব্যর্থ প্রশাসন।
৭। ঢাবি কতৃক মনিটরিং এর মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনায় ব্যর্থ প্রশাসন।
সাত কলেজে পরীক্ষা সমাপ্তের তিন মাসের মধ্যে সকল বিভাগের ফলাফল প্রকাশ করতে ব্যর্থ ঢাবি। কারণ হিসেবে জানা যায়, সঠিক সময়ের মধ্যে ফলাফল ঢাবিতে জমা দেওয়া হয়না। দেখা যায়, সঠিক সময়ের মধ্যে দুই একটি বিভাগের ফালফল জমা পড়লেও বেশীর ভাগ ডিপার্টমেন্টের ফলাফল পরে জমা হয়। ফলস্বরূপ সঠিক সময়ে রেজাল্ট প্রকাশ হচ্ছে না।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার ৭ বছরেও এসব সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ ঢাবি ও সাত কলেজ প্রশাসন।
এখন শিক্ষার্থীদের দাবিঃ
১। ফলাফল পরীক্ষা সমাপ্তের ৩ মাসের মধ্যে সকল বিভাগের প্রকাশ করতে হবে।
২। ব্যবহারিক এবং মৌখিক পরীক্ষা লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার ২০-২৫ দিনের মধ্যে সকল কলেজে সকল বিভাগে শেষ করতে হবে,যেমন টা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নোটিশ প্রকাশ করে তেমন করে ঢাবি ও নোটিশ প্রকাশ করতে হবে।
৩। পুনঃ নীরিক্ষার ফলাফল আবেদন করার ১ মাসের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে।
৪। একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করতে হবে,ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পরীক্ষা ফলাফল প্রকাশ করতে হবে।
৫। সমাবর্তন সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে করতে হবে না হয় আলাদা করতে হবে,কোন টিভি সমাবর্তন হবেনা।
৬। সাটিফিকেট এবং মার্কশীট আবেদন অনলাইন করতে হবে।
৭। সমন্বয় অটো করতে হবে ২-৩ কার্য দিবসের মধ্যে।
৮। সমন্বয় আবেদন অনলাইন সিষ্টেম করতে হবে।
৯। সমস্যা সমাধানের জন্য আলাদা কলেজে ঢাবি কতৃক সমস্যা সমাধান সেল করতে হবে।
উপরোক্ত সমস্যার বিষয়ে সাত কলেজের সমন্বয় ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেজাল্ট প্রকাশ করতে এবার একটু দেরী হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে বলেন, ঢাবির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণক বাহালুল হক চৌধুরী স্যার তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং এর মাঝে রোজা ও ঈদের ছুটি থাকায় রেজাল্ট প্রকাশে এবার একটু সময় লাগছে।
লিখিত পরীক্ষা সমাপ্তের ৩০ দিনের মধ্যে ব্যবহারিক এবং মৌখিক পরীক্ষা শেষ করার বিষয়ে জানান, মৌখিক পরীক্ষা সঠিক সময়ে হয়ে যায় তবে ব্যবহারিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাইন্সের বিভাগগুলোতে একটু বেশী সময় লাগে। ব্যবহারিক পরীক্ষার কমিটিতে যারা থাকেন তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দেখা যায় অনেক সময় তাদেরও নিজ ডিপার্টমেন্টের ক্লাস, পরীক্ষা,সেমিনার থাকে।
সবমিলিয়ে এইসব কারণে ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ হতে একটু সময় লেগে যায়। পুনঃনীরিক্ষার ফলাফল সমন্বয়ে বলেন, রেজাল্ট সমন্বয়ের কাজ চলমান আছে কিছুদিনের মধ্যেই সমন্বয় হয়ে যাবে। সামনে তীব্র সেশনজটের কোন সম্ভাবনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, সেশনজটের কোন সম্ভাবনা নেই।
ফলাফল জট এড়াতে প্রশাসন থেকে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, বর্তমানে সপ্তাহে আমাদের শিক্ষাকার্যক্রম চলে পাঁচ দিন। আমি ঢাবিতে সপ্তাহের প্রথম এবং শেষ দিনে ফোন দিই ফলাফলের বিষয়ে সার্বিক আলেচনা করি যাতে শীঘ্রই প্রকাশিত হয়। তিনি আরো জানান, আনার্স ১ম বর্ষ(২০-২১),২য় বর্ষ (১৯-২০) এবং ৩য় বর্ষ (১৮-১৯) সেশনের সকল বিভাগের ফলাফল চলতি মে মাসেই প্রকাশিত হবে।
শিক্ষার্থীরা চাই প্রশাসন থেকে যেন অতিশীঘ্রই এসব সমস্যার সমাধান করা হয়।
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজ হলো, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ,বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজ।
আর টাইমস/ এসএইচ