লালমনিরহাটের প্রথম বৈজ্ঞানিক ও ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদবুদ্ধ করেন হাজী তসলিম উদ্দিন (৮২)। তিনি ‘আলো সরল রেখা, মানবদেহের সার্কুলেশন সিস্টেম, কস্ট এফেক্টিভ স্নো, লোশন, পাউডার সহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য আবিষ্কার, বিজ্ঞান, ম্যাথমেটিক্স, রাজনীতি, দর্শন ও ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লেখক, যৌবনে সবুজ সেনার সম্পাদক ছিলেন। বৈজ্ঞানিক হাজী তসলিম উদ্দিনের পরিবার জানান, ১৯৪০ সাল বর্তমান লালমনিরহাট পৌর শহরের নামাটারী গ্রামের বিখ্যাত সৈয়দ পরিবারে তসলিম উদ্দিন জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা হাজী অছিম উদ্দিন ও চাচা হাজী কছিম উদ্দিন ছিলেন শহরের বিশিষ্ট্য ব্যবসায়ী এবং সমাজ সেবক। প্রয়াত আবুল হোসেন এমপি এবং প্রয়াত পৌর চেয়ারম্যান মকবুল হোসেনের ভাই হাজী তসলিম উদ্দিন।
তৎকালীন সময়ে হাজী তসলিম উদ্দিন লালমনিরহাট জেলা স্কুল পেরিয়ে কারমাইকেল কলেজ গ্রাজুয়েশন করেন। তিনিই ছিলেন অত্র এলাকার মধ্যে প্রথম গ্রাজুয়েট ব্যক্তি। তখন কুড়িগ্রাম ছিল জেলা। সেই সময় কুড়িগ্রাম রিভারভিউ স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় দিয়ে কর্মজীবনের শুরু করেন হাজী তসলিম উদ্দিন। বসবাস করতেন কুড়িগ্রাম জেলা শহরে। সেখানে দীর্ঘ ১৪ বছর শিক্ষকতা করা কালীন সময় শুরু হয় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযোদ্ধ। সেই মুক্তিযোদ্ধে ছিল হাজী তসলিম উদ্দিন ও তার সহধর্মিনী নাসিমা বানুও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বৈজ্ঞানিক হাজী তসলিম উদ্দিনের বড় ছেলে ড. তালাত নাসিম বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান চিরস্মরণীয় করে রাখতে সফল ভুমিকা রেখেছেন হাজী তসলিম উদ্দিন। রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতেন তিনি। এমনকি গ্রামের মানুষদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদবুদ্ধ করেন।
কুড়িগ্রাম রিভারভিউ স্কুলে শিক্ষকতা করার সুবাদে তার নেতৃত্বে ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধ আসর গড়ে তুলতে বাংলাদেশ বেতার (রেডিও) বাজিয়ে গ্রামের মানুষদের শুনাতেন। যুদ্ধে প্রতিরোধ দূর্গ গড়ে তুলতে ছাত্র জনতাদের খবর দিতেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তার ছাত্রদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডার সিরাজুল হক টুকু ও ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ। একাত্তরে সুদীর্ঘ নয় মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের পর অবশেষে বিশ্ব-মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। ১৯৭১-এ সংঘটিত সেই মহান মুক্তিযুদ্ধ আজ এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
ড. তালাত নাসিম আরো বলেন, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৭ সালে হাজী তসলিম উদ্দিন চলে আসেন নিজ শহর লালমনিরহাটে। বর্তমান লালমনিরহাট সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ১৯ বছর শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার দীর্ঘ ৩৩ বছরে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জুড়ে। এছাড়াও তিনিই ছিলেন লালমনিরহাট জেলার প্রথম বৈজ্ঞানিক। সেই সময় ‘আলো সরল রেখা না বক্র রেখায় চলে’ ‘মানবদেহের সার্কুলেশন সিস্টেম’ সহ বিভিন্ন মডেল আবিষ্কার করেন। এছাড়াও কস্ট এফেক্টিভ স্নো, লোশন, পাউডার সহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি আবিষ্কার করেছেন। লেখেছেন, বিজ্ঞান, ম্যাথমেটিক্স, রাজনীতি, দর্শন ও ধর্ম নিয়ে আর্টিকেলের সংখ্যা শতাধিক। যা জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সমাজ সেবকমুলক কাজে যৌবনে সবুজ সেনার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সেন্টার ফর হেলথ, এগ্রিকালচার এন্ড সোসিও-ইকোনমিক এডভান্সমেন্টস (চাষা)র স্বপ্নদ্রষ্টা ও কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৯ সালে লালমনিরহাট জেলা শ্রেষ্ট শিক্ষকও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বৈজ্ঞানিক হাজী তসলিম উদ্দিনের ৪র্থ ছেলে এ্যাড. মোঃ ইমাম রোজীন বলেন, বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষাবিদ হাজী তসলিম উদ্দিন আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি (৫ ডিসেম্বর) ২২ইং তারিখে রাত ৮ টায় ৪৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সমাজের সবস্তরের অসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ জানাজায় শেষে পারিবারিক গবরস্থানে তার মায়ের পাশে সমাহিত করা হয়। তিনি সৎ, ধার্মিক ও সহধর্মিণীসহ হজ্জ্ব পালন করেছেন। তার সন্তানের মধ্যে আজ কেউ বিজ্ঞানী, আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দেশ এবং বিদেশে কর্মরত আছেন।
বৈজ্ঞানিক হাজী তসলিম উদ্দিনের সহধর্মিণী মোছাঃ নাসিমা বানু বলেন, যুদ্ধের সময় আমার স্বামী হাজী তসলিম উদ্দিনও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতেন। আমার স্বামী কুড়িগ্রাম রিভারভিউ স্কুলে শিক্ষকতা করায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তার ছাত্রদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডার সিরাজুল হক টুকু ও ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে মুক্তিযোদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার প্রেরণা জুগিয়েছেন।