শেরপুরে অবাধে চলছে অবৈধ ইটভাটা। ইটভাটা স্থাপন নীতিমালার তোয়াক্কা না করে জেলা সদর সহ ৫ টি উপজেলাতেই পৌর এলাকায় এবং গ্রামাঞ্চলে হাটবাজার, স্কুল, মসজিদ ও ঘন জনবসতি পূর্ণ আবাসিক এলাকায় নির্মিত এসব অবৈধ ইটভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ এবং মাত্রাতিরিক্ত সালফার সমৃদ্ধ আমদানিকৃত কয়লা। ইটভাটার চিমনি থেকে ছড়িয়ে পড়া কালো ধোঁয়ায় পরিবেশের উপর পড়ছে মারাত্মক বিরুপ প্রভাব। কোথাও কোথাও তিন ফসলি কৃষি জমির উপর নির্মিত হয়েছে অবৈধ ইটভাটা।
ইটভাটার মাটি সংগ্রহে অবাধে কৃষি জমির মাটি অবৈধভাবে কেটে নেয়া হচ্ছে। সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে জমির মালিককে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে এস্কাবেটর বসিয়ে মাটি কেটে নেয়া হলেও স্থানীয় প্রশাসন রহস্যজনক কারণে নিরব।
এদিকে এসব জমির মালিকরা জানেনা এ ব্যাপারে সরকারি বিধিনিষেধ আছে। জমির মালিকরা বলেন,”আমার জমির মাটি আমি বিক্রি করবো তাতে অন্যের কি?” ভাটা মালিকদের অর্থের লোভে কৃষকরা মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে জমিগুলো উর্বরতা হারিয়ে অনাবাদি হয়ে পড়ছে। এসব ইটভাটার জন্য মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে কৃষি জমির টপসয়েলের মাটি কেটে নিয়ে। দীর্ঘদিন থেকেই অবৈধভাবে এই মাটির ব্যাবসা করে আসছেন একটি চক্র। রাত হলেই ছুটছে মাটি পরিবহনরত ড্রামট্রাক। এসব ড্রামট্রাকের কোনটিরই নেই বৈধ রোড পারমিট। ড্রাম ট্রাকের চাপায় ইতিপূর্বে মারাত্মক দুর্ঘটনায় শ্রীবরদী উপজেলার চৈতাজানী এলাকায় সোহাগ মিয়া (২৫), শেরপুর পৌর এলাকায় রংমিস্ত্রি নুরুল ইসলাম (৪০) নিহত হওয়া সহ হতাহত হয়েছেন অনেক পথচারী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইটভাটা মালিক জানান, ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নিলে কৃষকের ক্ষতি হয়। ব্যবসার স্বার্থেই দালালদের মাধ্যমে ফসলি জমির মাটিও কিনতে হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে মাঝে মধ্যেই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা আদায় সহ চুল্লি ভেঙ্গে দেয়া হয়। চলতি বছরের ১০ এপ্রিল জেলার নকলা উপজেলায় অনুমোদন বিহীন ৫টি ইটভাটায় পরিবেশ অধিদফতর পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ৫টি ইটভাটার নিকট হতে ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে ভাটাগুলো বন্ধ রাখতে অন্যথায় পরিবেশ সম্মত স্থানে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। কিন্তু আবারো উৎপাদনে ফিরে আসে এসকল ইটভাটা। নানাভাবে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে এভাবেই চলছে। পরিবেশ এবং প্রতিবেশ ধংস হলেও এসকল মোনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কিছু যায় আসে না।
উল্লেখ্য শেরপুর পরিবেশ অধিদফতরের দেয়া তথ্যমতে, শেরপুর জেলায় ইটভাটা রয়েছে ৬২টি যার মাত্র ৩ টি ভাটার বৈধ অনুমতি রয়েছে। অবশিষ্ট ৫৯ টির আবেদন নামঞ্জুর করে ইটভাটা বন্ধ এবং অন্যত্র পরিবেশ সম্মত স্থানে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তন্মধ্যে মাত্র ১৩ টি ইটভাটা বন্ধ থাকলেও অবশিষ্ট অবৈধ ৪৬ টি ইটভাটা বন্ধ করে দিতে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এরই আওরায় ২৮ ডিসেম্বর (বুধবার) জেলার শ্রীবরদী উপজেলার অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে আল আমিন ব্রিকস -১ কে ৩ লাখ, -২ কে ৪ লাখ, ফাতিমা ব্রিকস কে-৩ লাখ, জনতা ব্রিকস কে-২ লাখ, মুনিরা ব্রিকস কে-৩ লাখ, একতা ব্রিকস কে -৩ লাখ মোট ১৮ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এছাড়া আল আমিন ব্রিকস-২ এবং ফাতেমা ব্রিকস এক্সাভেটর দিয়ে ভেঙ্গে দেয়া হয়। এসময় পরিবেশ অধিদপ্তরের শেরপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আল মাহমুদ, পরিদর্শক সুশীল কুমার দাস সহ পুলিশ সদস্য, ফায়ার সার্ভিস এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এই অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং অবশিষ্ট সকল অবৈধ ইটভাটা বন্ধে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে বলে জানিয়েছেন শেরপুরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আল মাহমুদ।
সচেতন মহলের দাবি এসকল অবৈধ ইটভাটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হোক। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন ২০১৩ (সংশোধনী ২০১৯)ধারা ৫(৩ক) এ মাটির ব্যবহার কমিয়ে আনতে ভবনের দেয়াল, সীমানা প্রাচীর, হেরিং বোন রাস্তা ও গ্রাম সড়ক টাইপ-বি এবং ক্ষেত্রে ২০২২-২০২৩ সালে ৬০% ২০২৩-২০২৪ সালে ৬০% এবং ২০২৫ সালের মধ্যে ১০০% ব্লক ইটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এই নির্দেশ বাস্তবায়নে কোনোরূপ ব্যত্যয় বা ব্যর্থতার ক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ রয়েছে। অথচ শেরপুর বাস্তব ক্ষেত্রে এর সামান্যও প্রয়োগ নেই। ঠিকাদার এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগ এর কিছুই মানছেন না।
এবিষয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রীণভয়েস এর শেরপুর জেলার সভাপতি সাংবাদিক রফিক মজিদ বলেন, ” আমরা এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতির শিকার। তার উপর ইটভাটার প্রভাবে আরও বিপর্যস্ত হচ্ছে আমাদের পরিবেশ, ব্যহত হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন। স্বাস্থ্য ঝুঁকি সহ নানা সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যেই শেরপুর সহ সারাদেশে পরিবেশ বান্ধব বালি ও সিমেন্টের ব্লক ইট চালু হয়েছে। কিন্তু আমরা কেউই এই ইট ব্যবহার সচেতন নই। প্রচার প্রচারণাও তেমন নেই। তাই এবিষয়ে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদেরও সচেতন হতে হবে। সেইসাথে ইটভাটা মালিকদেরও মাটির ইটের পরিবর্তে ব্লক ইটের ব্যবসায় ফিরতে আহবান জানান তিনি।”