রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার পূর্ব মৌকুড়ী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আকুল শেখ। এক মাস আগে ৭৫ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজের চারা রোপন করেছিলেন তিনি। এরই মধ্যে দুবার জমিতে সেচ দিয়েছেন। কিন্তু চারা বড় হওয়ার পরিবর্তে মাথা হলুদ হয়ে ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। ৭৫ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজের চারা রোপণ ও সেচ দিতে তাঁর প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্যাকেটজাত ছাড়াই ভালো বীজ বলে এলাকার এক ব্যক্তি এই বীজ তাঁর কাছে বিক্রি করেছিলেন। ভেজাল বীজের কারণে রোপনকৃত চারা মরে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি।
সরেজমিনে পাংশা-কালুখালী ও বালিয়াকান্দি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ শুধু পেঁয়াজ ক্ষেত। কেউ কেউ জমিতে সেচ দিচ্ছে,কেউ কেউ নিরাণী দিচ্ছে। আবার অনেক কৃষকের জমিতে রোপনকৃত পেঁয়াজ চারা মরে গেছে। পেঁয়াজের চারা মরে লাল হয়েগেছে। মরে যাওয়া পেঁয়াজ খেতে নেই কৃষকের ব্যস্ততা।
বালিয়াকান্দি উপজেলার পূর্ব মৌকুড়ী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি মোঃ হাসেম আলী শেখ বলেন, এবছর আমি ১২৫ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ রোপন করেছি। রোপন থেকে এখন পর্যন্ত একলক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। আমাদের এলাকা থেকে সজিবের কাছ থেকে বীজ কিনেছিলাম। চারা লাগানোর কিছুদিন দেখি গাছ লাল হয়ে গেছে। এখন তো সব মরে ছোন হয়ে যাচ্ছে। এইযে এত টাকা খরচ করে পেঁয়াজ লাগালাম এখন আমার এই ক্ষতি পূরণ কে দিবে?
চাষি বিপ্লব বলেন, আমাদের এলাকার সজিব ভালো বীজের কথা বলে ভেজাল বীজ দিছে। আমি ৬৬ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ রোপন করেছি। সব গাছ মরে গেছে। কিস্তির টাকা খরচ করে পেঁয়াজ লাগিয়ে ছিলাম। এখন সব লোকসান। আমার মত শত শত কৃষক আছে তাদেরও একই অবস্থা। আমরা সজিবের বিচার চাই।
পাংশা উপজেলার যশাই ইউনিয়নের সোমসপুর গ্রামের কৃষক আবেদ আলী মন্ডল বলেন, আমি এলাকার লাল্টুর কাছ থেকে দুইকেজি বীজ দশ হাজার টাকা দিয়ে কিনে ছিলাম। সেই বীজের চারা ছয় পাকি জমিতে রোপন করেছিলাম। জমিতে লাগানোর কয়েকদিন পর দেখি মরে যাচ্ছে। আমার খরচ হয়েছে ৬০-৭০ টাকা। এখন আমি তো খুবই চিন্তায় পড়ে গেলাম।
কৃষক ওহেদ আলী আরও বলেন,আমি পেঁয়াজ চাষের জন্য ৮০ হাজার টাকা এনজিও থেকে কিস্তি নিছি। সার,শ্রমিক,চাষ দিয়ে অর্ধেকের বেশি টাকা খরচ হয়েগেছে। ভেবেছিলাম পেঁয়াজ ঘরে তুলে কিস্তি পরিশোধ করবো। এখন আমার যে কাম হলো তাতে বেঁচে থাকাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
পাংশা উপজেলার যশাই ইউনিয়নের সোমসপুর গ্রামের বীজ বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম (লাল্টু) বলেন, আমি তিন বছর ধরে পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করি। গত কয়েক বছরে কখনো অভিযোগ আসে নাই বীজ নিয়ে। এবছর অনেক কৃষকই বলছে তাদের পেঁয়াজ চারা মরে যাচ্ছে।
শহিদুল ইসলাম (লাল্টু) আরও বলেন,প্রতিবছর পাংশা উপজেলার বিভিন্ন কৃষকদের কাছ থেকে প্রায় ১ শত কেজি পেঁয়াজ বীজ ক্রয় করি। পরে সেই বীজ কৃষকদের কাছে বিক্রি করে থাকি। বীজ কিনে আনার সময় তো বোঝার উপায় নেই এটা ভালো না খারাপ। কৃষকদের কাছ থেকে এনে যে বীজ বিক্রি করেছি সেই বীজে সমস্যা দেখা দিছে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেট বীজে কোন সমস্যা হয় নাই।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এই জেলায় এবছর ৩৩ হাজার ১৫৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে।
পাংশা-কালুখালী-বালিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে,পাংশা উপজেলায় ৮ হাজার ২ শত হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করা হয়েছে। ভেজাল বীজের কারণে এরমধ্যে ২১৬ হেক্টর জমির পেঁয়াজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কালুখালী উপজেলায় ৮ হাজার ৯৯২ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ রোপন করা হয়েছে। এরমধ্যে ভেজাল ও নিম্নমানের বীজের কারণে ১৫০ হেক্টর জমির পেঁয়াজ খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বালিয়াকান্দি উপজেলায় ১১ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে পেঁ য়াজ আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে ৭০৫ হেক্টর জমির পেঁয়াজ নষ্ট হয়েগেছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৭ থেকে ৮ শত কৃষক।
পাংশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রতন কুমার ঘোষ বলেন,কৃষকেরা আমাদের কাছে অভিযোগ দিয়েছে। এ বিষয়ে আমারা তদন্ত করে দেখেছি যে এলাকার কিছু মৌসুমী বীজ বিক্রেতার কাছ থেকে এই বীজ কিনেছে। যে বীজ কিনেছে সেগুলো দুই থেকে তিন বছর আগের হওয়ায় এই পরিস্থিতি হয়েছে।
বালিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রফিকুল ইসলাম বলেন, বালিয়াকান্দি উপজেলায় হালি পেঁয়াজের চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই সুযোগে একটি চক্র কৃষকের ঘরে সংরক্ষিত বীজ বলে এলাকায় ভেজাল ও নিম্নমানের বীজ বিক্রি করেন। সেই বীজ কিনে কৃষকেরা এখন লোকসানের মুখে। অনেক কৃষক অভিযোগ করায় আমরা সরেজমিন তদন্ত করে ভেজাল বীজের সত্যতা পেয়েছি। সংশ্লিষ্ট বিক্রেতার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে কৃষকদের বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জমি ফেলে না রেখে ভুট্টা বা অনান্য ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।