৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন ছিল একটু ব্যতিক্রম। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় সরকারি দল আওয়ামীলীগ নিজ দলের প্রার্থী ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে রাখে। কারণ এবারের নির্বাচনের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল বিএনপি ভোটে না আসলেও কিভাবে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো যায়। এর সাথে শান্তি পূর্ণ ভোট অনুষ্ঠানও ছিল আর একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভোটের আগে পরে সহিংসতার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও অন্য নির্বাচনগুলো থেকে তুলনামূলক সহিংসতা কম হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন একটি বড় দল নির্বাচনে না আসায় সহিংসতা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেনি।
নির্বাচনের আগে থেকে বিএনপি ও মিত্রদের দাবি ছিল সরকারকে পদত্যাগ করে একটি নিরপেক্ষ সরকারে হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। যারা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। কারণ তারা মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব না। কিন্তু আওয়ামীলীগ সংবিধান স্বীকৃত উপায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধ পরিকর ছিলেন। শেষমেষ বিএনপি নির্বাচনে না আসলে দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়। আওয়ামীলীগ তার মিত্রদের সাথে নিয়ে নির্বাচনের ট্রেনে উঠে পরে। আওয়ামীলীগ বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকে যাতে ভোটারদের আকৃষ্ট করে নিজেদের জনপ্রিয়তা জানান দেওয়া যায়। এরই অংশ হিসেবে নির্বাচন ইশতেহার ঘোষণা, জনপ্রিয় প্রার্থীদের মনোনয়ন, মাঠে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা সহ ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে বেশ কৌশলী ভূমিকায় দেখা যায়। এতে অনেক সিটিং এমপি মনোনয়ন বঞ্চিত হন। সাধারণত নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা ভোটারদের নজর কাড়তে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি নিয়ে মাঠে নামেন। নিজেদের যোগ্যতা ও পরিকল্পনা ভোটারদের জানাতে সভা সমাবেশের আয়োজন করেন।
ভোটের আগে প্রার্থীদের ওয়াদা ও ভোটারদের প্রত্যাশা জানতে সরেজমিনে ঝিনাইদহ ৩ আসনের (মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত) বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে কথা বলি। জানা যায়, ২০০৮ সালের আগে বিএনপি থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জনাব শহিদুল ইসলাম মাস্টার পরপর চার বার নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি জোট ৩০ টিরও কম আসনে জয়লাভ করে। তখন এই আসনটি তাদের হাত ছাড়া হয়ে যায়। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে জনাব শফিকুল আজম খান চঞ্চল দুইবার ও জনাব নবী নেওয়াজ একবার জয়লাভ করেন। ২০২৪ সালে এ আসনে প্রার্থী বদল করে প্রথম বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অব:) জনাব সালাউদ্দীন মিয়াজী কে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়।
ভোটারদের নজর কাড়ার একটি কৌশল হচ্ছে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া যার মাধ্যমে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরেন প্রার্থীরা। এই প্রতিশ্রুতি কখনো কখনো অতিরঞ্জিত থাকে। বাস্তবের সাথে মিল না থাকায় অনেক সময় তা আর বস্তবায়ন হয় না। এতে জনগণের মধ্যে একটি ধারণা থাকে ভোটের আগে নানা ওয়াদা করলেও পরে দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়। মহেশপুর উপজেলার বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে প্রার্থীদের যোগ্যতা, পূর্বের কর্মকান্ড এবং ভোটার হিসেবে তাদের প্রত্যাশা নিয়ে কথা বলে বুঝতে চেয়েছিলাম প্রার্থীদের কিভাবে মূল্যায়ন করছেন তারা। এরই অংশ হিসেবে এসবিকে, পান্তাপাড়া, বাশবাড়িয়া ও স্বরুপপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন পথসভায় ও উঠান বৈঠকে উপস্থিত থেকেছি। ভোটারদের মূল ক্ষোভ ছিল নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের কেও আর খোঁজ খবর রাখেন না। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্রিকাতে প্রার্থীদের নির্বাচন পরবর্তী উন্নয়ন চিন্তা নিয়ে প্রতিবেদন দেখেছি।
এই আসনটিতে নৌকা প্রতীকের মেজর জেনারেল (অব:) জনাব সালাউদ্দীন মিয়াজী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জনাব শফিকুল আজম খান চঞ্চলের মধ্যে ভোটের মূল লড়াই হয়। দুজন প্রার্থীই উন্নয়নের রোডম্যাপ তুলে ধরেন। নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব:) জানাব সালাউদ্দীন মিয়াজী জয়লাভ করেন। তিনি মূলত চরটি বিষয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করার অঙ্গিকার করেছিলেন।
মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর উপজেলার আবহাওয়া কৃষি কাজে জন্য উপযুক্ত। এখানে মহেশপুরের দত্তনগরে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম কৃষি খামার রয়েছে। আছে অসংখ্য বিল, বাওড় ও জলাশয়। তিনি দত্তনগরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এছাড়াও আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষি ও মৎস্য চাষের বিভিন্ন পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন মানুষের মাঝে। কৃষকদের পণ্যের ন্যায্য দাম, হিমাগার নির্মাণ, সার ও বীজের সহজলভ্যতা সহ কৃষকের সামগ্রিক উন্নয়নের চিন্তার কথা বারবার প্রচার করেছেন। শিক্ষার উন্নয়নে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ ও অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা অনুরাগী দিয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠন, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, ভোকেশনাল ও ট্যাকনিক্যাল শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে শিক্ষিত জনশক্তি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথ তৈরি করার কথা জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য সেবা মানুষ দৌড় গোড়ায় পৌঁছে দিতে হাসপাতালগুলো এমন ভাবে আধুনিকায়ন করবেন যাতে মানুষ যশোর বা ঢাকার সেবাগুলো উপজেলাতে বসেই পাই। কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবার মান বৃদ্ধি ও ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা নিবেন। পরিবেশ রক্ষাতে সচেতনতা তৈরি, বৃক্ষরোপণ, নদ-নদী রাস্তা ও সরকারি জমি দখল রোধ এবং পরিকল্পিত ভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন করে মহেশপুর কোটচাঁদপুর উপজেলাকে সারা দেশের কাছে একটি মডেল হিসেবে উপস্থাপন করবেন। এছাড়াও ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র, তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি, সড়ক যোগাযোগ, আইটি প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণ, কপোতাক্ষ নদ ও বাওড় ঘিরে মৎস্য চাষ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি, সমাজে সম্প্রীতির বন্ধন ছড়িয়ে দেওয়া সহ আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন মোটাদাগে তার পরিকল্পনার অংশে আছে। যার মূলে ছিল মানুষের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত, শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, তরুণদের উদ্ভাবনী চিন্তাগুলো একই ফ্রেমে এনে মহেশপুরের বিভিন্ন পন্যের ব্রান্ডিং, সরকারি বেসরকারি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে আত্মকর্মসংস্থান ও চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা , ন্যায্যতার ভিত্তিতে মানুষের মাঝে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়া সহ আধুনিক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনগণের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা। আর এগুলো একটি মানবিক ও কল্যাণকর সমাজ ব্যবস্থা গঠনে সহায়তা করবে যেটি আমাদের মুক্তি যুদ্ধের চেতনার অগ্রভাগে ছিল।
বর্তমান সরকারের মেয়াদ ২ মাসের একটু বেশি। এই অতি অল্প সময়ে কোনো ব্যক্তির কর্মকান্ড মূল্যায়ন করা কঠিন কাজ। কিন্তু কিছু বিষয় জানিয়ে দিচ্ছে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কতটা ইচ্ছা শক্তি নিয়ে কাজ করছেন তিনি। পূর্বের দেওয়া ওয়াদাগুলো বাস্তবে রূপ দিতে প্রথম দিন থেকেই কাজ শুরু করেছেন। সংসদে প্রথম দিনেই তিনি মহেশপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জোর দাবি জানিয়েছেন। ইতোমধ্যেই কপোতাক্ষ নদের কচুরিপানা পরিষ্কার করে একটি মহা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। খালিশপুরে কুঠি বাড়ি সংস্কার করে একটি ট্যুরিজম কেন্দ্র নির্মানের প্রাথমিক যাচাই-বাছাই কাজ চলমান। স্বাস্থ্য সেবা মানুষের দৌড় গোড়ায় পৌঁছে দিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে মেডিকেল ক্যাম্প করেছেন যা চলোমান থাকবে। নতুন নির্মিত ভৈরবা ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ডাক্তার নিয়োগের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং এটি চালু হলে সীমান্তবর্তী এলাকায় স্বাস্থ্য সেবার আমূল-পরিবর্তন দেখা যাবে। নির্বাচিত হয়েই তিনি প্রতিটি ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন যেখানে কোথায় কি ধরনের কাজ করতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ আছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনগনের প্রত্যাশা বাস্তবায়নের কথাও জানিয়েছেন। এছাড়াও নিজস্ব ফান্ড থেকে গরীব দুস্থ মানুষের সহায়তা প্রদান করছেন। মহেশপুর কোটচাঁদপুরের প্রতিটির জনপদের উন্নয়নে পরিকল্পনা সাজিয়ে বাস্তবায়নে ছুটে চলছেন দিন রাত। ধারণা করা যায়, কিছু উন্নয়ন স্বল্প সময়ের মধ্যে দৃশ্যমান হবে আবার কিছু উন্নয়ন সময় সাপেক্ষ। তার পরিকল্পনাগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন হলে শিক্ষা-সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, কৃষি, কর্মসংস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থার ও আইন শৃঙ্খলার ব্যাপক উন্নয়ন হবে যা একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হবে দেশ বিদেশে।
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, তিনি একজন কৃষি উদ্যোক্তা। কৃষি, মৎস্য চাষ এবং হর্টিকালচারে অসামান্য অবদান রাখায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট হতে ১ টি স্বর্ণ পদক ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট হতে তিনি ১ টি স্বর্ণ ও ১টি রৌপ্য পদক অর্জন করেছেন। পেশাগত জীবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব, উপাচার্য বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), জিওসি ৬৬ পদাতিক ডিভিশন ও এরিয়া কমান্ডার রংপুর এরিয়া সহ দেশ বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান মানুষের কল্যানে উৎসর্গ করেছেন এবং প্রত্যাশা করছেন এর মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
এখন, পরিকল্পনাগুলো যথাযথ ভাবে নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দল, জনপ্রতিনিধি, অংশিজনসহ বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি টিম গঠন করতে হবে। যেখানে মাটি পানি ও কৃষি বিজ্ঞানী, স্থানীয় সরকার গবেষক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানী, পরিবেশ ও নগর পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ, যোগাযোগ ও আইটি বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ এবং চিকিৎসক ও প্রকৌশলী থাকবে। এটি হবে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিশেষজ্ঞ টিম যারা একটি ডিটেইলস মাস্টার প্লান তৈরি করে বাস্তবায়নে কাজ করবে। অন্যদিকে, সরকারের কাছ থেকে অর্থ ছাড় করতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সামগ্রিক ভাবে বলা যায়, স্বল্প সময়ে দৃশ্যমান কর্মকান্ডগুলো ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। তবে আরো সময় অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচনের অঙ্গিকারগুলো কতটুকু পূরণ হলো তা জানতে।
মো. শাহিন রেজা
সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।