উপরে টিনের ছাউনি ও পলিথিনের বেড়া, বাঁশের চাপা দিয়ে ঝুপড়ি ঘরে বৃদ্ধা দম্পতির বসবাস। শেষ বয়সেও দেখার কেউই নেই তাদের। মাথা গোঁজার ঠিকানা ছোট একটি ঘরে। তাও আবার অন্যের জমিতে।
জরাজীর্ণ, ভাঙ্গাচুরা, লক্কর-ঝক্কর ঝুপড়ি ঘরে চরম দুর্ভোগের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন এই দম্পত্তির। রোদে শুকিয়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করেন সেই ভাঙ্গা ঘরে। ঘরের এমনই অবস্থা ভেতরে ঢুকতে হলে হামাগুড়ি না খেয়ে ঢোকার কোনো উপায় নেই। বৃষ্টি হলে পানিতে সয়লাভ হয়ে যায় ঘরের মেঝে। ঘরের মধ্যে দিনের বেলাও পৌঁছে না সূর্যের আলো। পায়নি কোনো সরকারি সেবা। তবুও নিরম্নপায় হয়ে সেখানেই বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। ঝড়-বৃষ্টি- শীতে স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে তাদেন বিছানা। রোগা শরীর নিয়ে কোনো মতে কাজ করেন। কাজ না করতে পারলে পান্তা ভাত আর পোঁড়া মরিচ জোটে কপালে। কখনও কখনও না খেয়েও দিন পার করতে হয় এই দম্পতির।
মানবেতর জীবনযাপনের এই গল্প বৃদ্ধা দম্পতি উত্তম চন্দ্র দেবনাথ ও তাঁর স্ত্রী কানন বালা দেবীর। নামে দেবী হলেও কাজের নাই কিছুই। এই দম্পতি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার দেউলী সুবিদখালী ইউনিয়নের পূর্ব সুবিদখালী গ্রামে বসবাস করেন। কিন্তু সেখানে তার ভিটেবাড়ি কিছুই নেই। নিকটাত্মীয় ও আপন বলতে কেউই নেই তাদের। তাঁর প্রথম স্ত্রী পাগল হয়ে নিরম্নদ্ধেস হয়েছেন কয়েক যুগ আগেই। সে বেঁচে আছেন কিনা মরে গেছেন তাও জানেন না উত্তম। সেই ঘরে এক পুত্র ও এক মেয়ে ছিলো। পরে উত্তম দেবনাথ কানন বালাকে বিবাহ করলেও তাঁরও অবস্থা আগের স্ত্রী’র মতো। সে ঘরে কোন সন্ত্মান নেই। মেয়েটিকে মামাদের সহযোগীতায় বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটিও বিয়ের কয়েক বছর পর নেশার কারনে পাগল হয়ে যায়। এরপর পুত্রবধুও শিশু কন্যাটিকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যান, আর ফিরে আসে নি। দারিদ্র্যতা ও অসহায়ত্বের কারণে সেই মেয়ের পক্ষেও তাদের খোঁজ রাখাও সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই তাদের দেখবার মতো কেউই নেই এখন। বয়সের ভার এবং রোগাক্রান্ত্ম শরীর নিয়ে হাটাচলা উত্তমের পক্ষে কষ্টসাধ্য। তবুও তাকে বের হতে হয় পেটের তাগিদে। কাজ করে যা পায় তা দিয়েই চালান দু’জনের রান্নাবান্না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার পূর্ব সুবিদখালী গ্রামে লঞ্চঘাট এলাকার দেবনাথ বাড়িতে ১০ হাত আর ৫ হাতের ছোট্ট একটি ঝাপড়ার ঘরে এলোমেলো পুরনো কাপড়-চোপড়। ঘরের পশ্চিম এককোণে চুলা, আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাঁড়ি-পাতিল। এসব নিয়েই তাদের সংসার। এ দেশ ছেড়ে নিজেদের জমিজমা বিক্রি করে বহু বছর আগে অণ্য দেশে পরিবারসহ যান উত্তম দেবনাথ। সেখানে কয়েক বছর কাটানোর পরে পরিবার ও সন্ত্মান নিয়ে ফিরে আসেন দেশে। দেশে নেই কোন বাড়ি বা ঘর। কোন উপায় না পেয়ে উপজেলার পূর্ব সুবিদখালী গ্রামের শ্বশুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। অভাবের সংসারে শ্বশুরও তাদের আলাদা করে দেয়। শ্বশুর বাড়ির পুকুর পাড়ের টিনের ঝাপড়া আর পাতার বেড়া দিয়ে ছোট্ট একটি ঘরে শুরু করেন সংসার। সংসার আর বেশিদিন টিকলো না। প্রথম স্ত্রী পাগল হয়ে রাস্ত্মায় রাস্ত্মায় থাকেন। তাকে ধরে এনে সিকলে বেধেঁ রাখালেও ছিকল ছিঁড়ে পালাতেন। শেষবারে ছিকল ছিড়ে যে পালিয়েছেন আজও ফিরেনি প্রথম স্ত্রী। পরে শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে আবারও পটুয়াখালীর গলাচিপাতে বিবাহ করান কানন বালার সাথে। সে ঘরে নেই কোন সন্ত্মান। তিনিও মানশিক রোগে ভুগছেন। ছেলেটাও কোথায় যানো চলে গেছে। আপনজনরা তাদের না দেখলেও চাচাতো সমন্ধিরা এক খন্ড জমি দেন এবং টিনের ঝাপড়া দিয়ে ঘর তুলে বাস করা শুরম্ন করেন।
কষ্টের জীবনের কথা জানতে চাইলে উত্তম দেবনাথ বলেন, ‘বাবারে খুব কষ্ট করি। রাইতে (রাতে) ঘরে থাকার মতো কোন পরিবেশ নেই। আমি এই ভাঙ্গাচুরা ঘরে খুবই কষ্ট করে থাকি। লঞ্চঘাট এলাকায় ড্রেনের কাজ চলছে। নদীর পানি উঠে ঘরের চারপাশ তলিয়ে গেছে। এমনকি সামান্য বৃষ্টি হলেই ঘরের উপরের ছাউনি থেকে পানি পড়ে, ঘরের ভিতরের সব কিছু ভিজে যায়। দু’জনে কোন রকম কাইত (কাত) হয়ে শুয়ে পড়ি। যাতে রাতটা কেটে যায়। কাজ করতে সমস্যা হয়। পা ফুলে উঠে। টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারি না।
সরকার ভূমিহীনদের ঘর দিচ্ছে আপনি পাননি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েকবার আইডি কার্ড দিয়েছিলাম। তারা এসে দেখেও গেছেন। নিজের কোন জমি নাই এবং আপন সম্বোন্ধিরাও জমি দিতে চান না। তাই সরকারি ঘরও পাই না। আমি যদি এখান থেকে অন্য যায়গায় যাই। তাহলে আমাকে কাজ কে দিবে। কাজের জন্য এখানে থাকি। যদি সরকারি ভাবে একটা ঘর দিতো তাহলে একটু শান্ত্মিতে থাকতে পারতাম।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মোশারফ হাওলাদার বলেন, আসলেই উত্তম দেবনাথ গরীব মানুষ। তার জন্য একটি ঘর খুবই প্রয়োজন।
দেউলী সুবিদখালী ইউপি চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন খান বলেন, আমার ইউনিয়নে যারা প্রকৃতি অসহায় রয়েছে তাদেরকে যাচাই-বাছাই করে ঘর দেওয়া হবে। কোন অসহায় বা দুঃস্থ ব্যাক্তি বাদ যাবে না।