রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) উন্নয়ন ও সেবার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে গাড়ি কেনা হয়েছে। গাড়িগুলোর চাহিদাও অনেক বেশি।
এসব গাড়ি ভাড়া খাটিয়ে প্রতিবছর কোটি টাকা আয় হওয়ার কথা। প্রশ্ন উঠেছে আরডিএ’র এই গাড়ি পুরো বছর ধরে চললেও ভাড়ার টাকা যায় কোথায়? ব্যাপক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আরডিএ’র গাড়ির ভাড়ার টাকা কোথায় যায়। মূলত মুষ্টিমেয় কর্মকর্তা-কর্মচারিরা সারাবছর গাড়ি ভাড়া দিয়ে সামান্য কিছু টাকা রাজস্ব ও কিছু আরডিএ’র কোষাগারে জমা দেন। আর বাকি টাকা নিজেদের পকেটে ভরেন।
জানা যায়, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৫টি গাড়ি রয়েছে। গাড়িগুলো মধ্যে রয়েছে ভাইবেটার (রোড রোলার), এস্কেভেটর, চেইন ড্রোজার, রোড রোলার, প্লেওডার। এরমধ্যে ভাইবেটার (রোড রোলার) ও এস্কেভেটর সচল রয়েছে। প্লেওডার কেনার পরপরই নষ্ট। রোড রোলার গাড়িটিও মেরামত না করে ফেলে রাখা হয়েছে। পুরাতন চেইন ড্রোজার গাড়িটি ওয়াকশনে বিক্রির চিন্তাভাবনা করছে আরডিএ কর্তৃপক্ষ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সচল গাড়ি দুটির মধ্যে রোড রোলার ও এস্কেভেটর থেকে তিন বছরে আরডিএ কোষাগারে ভাড়ার টাকা জমা পড়েছে মাত্র ৯ লাখ ৫০ হাজার ৯শ’ টাকা। তিন বছরের ভাড়ার তালিকায় দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৫শ’ টাকা, ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৭ লাখ ২০ হাজার ৯শ’ ও ২০২২-২৩ অর্থ বছরে (আট মাস) দেখানো হয়েছে মাত্র ৩৪ হাজার ৫শ’ টাকা।
দেখা গেছে, সচল দুটি গাড়ির চাহিদা অনেক। এই গাড়ির মধ্যে রোড রোলারের ভাড়া প্রতিদিন ৮ হাজার ২শ’ টাকা ও এস্কেভেটরের ১১ হাজার ২শ’ টাকা। সরকারী হিসাব অনুযায়ী গাড়িগুলো মাসে ২২দিন চালার কথা। সেই হিসাবে ২২দিনে রোড রোলারের ভাড়া আসে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪ শ’ ও এস্কেভেটরের ভাড়া আসে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৪শ’ টাকা। দুটি গাড়ির পুরো এক বছরের ভাড়া হিসাব করলে আসে, রোড রোলারের ২ কোটি ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮শত ও এস্কেভেটরের ২ কোটি ৯৫ লাখ ৬ হাজার ৮শ’ টাকা। এক বছরে দুই গাড়ির মোট ভাড়া আসার কথা মোট ৫ কোটি ১২ লাখ ১ হাজার ৬শত টাকা। আর দুই গাড়ির ৩০ দিন করে পুরো বছরের ভাড়া হিসাব করলে আসে ৬ কোটি ৯ লাখ ৮৪ হাজার। অথচ এই দুটি গাড়ির তিন বছরে ভাড়া দেখানো হয়েছে মাত্র ৯ লাখ ৫০ হাজার ৯শ’ টাকা। আর বাকি টাকা যায় কিছু অসাদু কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পকেটে।
দেখা গেছে,, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে (আট মাস) দুটি গাড়ির ভাড়া জমা পড়েছে মাত্র ৩৪ হাজার ৫শ’ টাকা। এখন প্রশ্ন হলো এস্কেভেটরের ভাড়া প্রতিদিন ১১হাজার ২শ’ টাকা হলে মাসের ২২ দিন এই গাড়ি যদি ভাড়া খাটানো হয় এক বছরে এর ভাড়া দাঁড়ায় ২ লাখ ৪৬ হাজার চারশ টাকা। অথচ দুটি গাড়ির আট মাসে ভাড়া দেখানো হয়েছে মাত্র ৩৪ হাজার ৫শ’ টাকা। হিসাব অনুযায়ী এস্কেভেটর তিন দিন চললে ভাড়া আসে ৩৩ হাজার ৬শ’ টাকা। তাহলে কি এই দুটি গাড়ি বছরে মাত্র তিন দিন চলেছে ? বাকি দিনগুলো কি দুটি গাড়ি ভাড়া দেয়া হয়নি? ভাড়া দেয়া হলে সেই টাকা গেলো কোথায় ?
আরডিএ সূত্রে জানা গেছে, এই দুটি গাড়ির দায়িত্বে রয়েছেন প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক ও সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জমান। গাড়ি দুটির ভাড়া দিয়ে থাকেন এই দুই কর্মকর্তা। গাড়ির চালক হিসাবে রয়েছেন কর্মচারি শ্রী সুবাস চন্দ্র সেন ও ইসমাইল হোসেন বাবু।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ গাড়ি দুটি সরকারী শুক্র-শনিবার ছুটির দিন বাদ দিলে ২২ দিন চলার কথা। কিন্তু গাড়ি দুটো মাসের ৩০দিনই চলতে দেখা যায়। সকাল ৯টা থেকে অফিস চলাকালীন সময় ৫টা পর্যন্ত এসব গাড়ি চলার কথা থাকলেও কখনো কখনো রাত-দিন এই গাড়ি চলে। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক তার নিজস্ব প্রকল্পের ঠিকাদার ও বাইরের নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারকে গাড়ি দুটো ভাড়া দেন। নিজের প্রকল্প তো বটেই, বাইরের ভাড়ার যে টাকা আসে সেখান থেকে অল্প কিছু টাকা আরডিএ’র কোষাগারে জমা দিয়ে বাকি টাকা ভাগ বাটোয়ারা হয় প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক ও সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান এবং চালকসহ কিছু কর্মকর্তার মধ্যে। এতে লাখ লাখ টাকা যেমন সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়, তেমনি আরডিএ’র কোষাগারেও টাকাগুলো জমা হয় না। এতে অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা যায়।
জানা গেছে, এই গাড়ি দুটি সচল রাখার জন্য আরডিএ থেকে তেল ও মবিল নেয়া হয়। আবার যে ভাড়া নেয় তার কাছ থেকে চালককে প্রতিদিন দিতে হয় ১৫শ’ টাকা। গাড়ি নিয়ে যাওয়া-আসার পুরো খরচ দিতে হয় ভাড়াটিয়াকেই। সেই হিসাবে এই গাড়ি চালকের আরডিএ’র বেতনসহ মাসিক আয় দাঁড়ায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। অথচ তিনি অস্থায়ী ভিত্তিক কর্মচারি। এভাবেই গাড়ি ভাড়ার টাকা কোষাগারে জমা না দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারি ও চালকরা গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। যদিও গাড়ির চালক দাবি করেছে, কেউ ভাড়া নিলে তাকেই দিতে হয় ২ হাজার টাকা। চালকের ভাষ্যমতে শুক্র ও শনি এবং অতিরিক্ত সময় যে গাড়ি চলানো হয় সেটি চালকের স্যার ও স্যারের স্যারও অবগত থাকেন।
অনেক খোঁজ করে অবশেষে গত রোববার (২এপ্রিল) বিকেলে পাওয়া যায় এস্কেভেটর চালক শ্রী সুবাস চন্দ্র সেনকে। কৌশলে গাড়ি ভাড়া নেয়ার ওযুহাত দিয়ে তার কাছে যাওয়া হয় নগরীর ভদ্রায়। সেখানে কথা হয় আরডিএ’র এই গাড়ি চালক সুবাস চন্দ্রের সাথে। তিনি আরডিএ’র গাড়িগুলো কিভাবে চলে কতদিন চলে সব জানান। তিনি বলেন, গাড়ি ভাড়া নিলে ভাড়াটিয়ার তেল মবিল, গাড়ির আসা যাওয়া খরচ দিতে হয়। আমাকে দিতে হয় প্রতিদিন ২ হাজার টাকা। ওভার টাইম দুই ঘন্টা চললে আমাকে দিতে হবে ২৪ শ’ টাকা। এই টাকা কাকে কাকে দিতে হয় প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সেটি আপনার দেখার বিষয় নয়, আমাকে টাকা দিবেন আমি স্যারদের ম্যানেজ করবো। তিনি বলেন, মাসেই নয়, পুরো বছরেই এই গাড়ি চলে। কোনো ছুটি নেই। তিনি আরো বলেন, গত চারমাসে আমি ছুটি পাইনি। আজ (রোববার ২ এপ্রিল) শরীরটা খারাপ তাই চারমাস পর ছুটি নিয়েছি। তাছাড়া বছরে আমার ছুটি অনেক কম। সারাবছরই আমাকে এই গাড়ি চালাতে হয়।
চালকের ভাষ্যমতে এই চারমাসে এস্কেভেটরের ভাড়া ২২দিন ধরলে আসে ২ লাখ ৪৬হাজার ৪শ’ টাকা। আর ৩০দিন ধরলে আসে ৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। ধরাই যায় পুরো বছরে শুধু মাত্র এস্কেভেটরের ভাড়াও দশভাগের এক ভাগও আরডিএ’র কোষাগারে জমা হয়নি।
জানা গেছে, আরডিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মাসিক বেতন প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এরমধ্যে অস্থায়ী কর্মচারিদের বেতন ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, স্থায়ী কর্মচারির বেতন ৩৮ লাখ, ঝাড়ুদারের বেতন ৩৫ হাজার টাকা, আনসারের বেতন (নিরাপত্তা কর্মী) ২লাখ ৪০ হাজার টাকা, অবসরের কর্মচারিদের বেতন ২ লাখ ২০হাজার টাকা। এতে দেখা যায় বছরে কর্মচারি-কর্মকর্তাদের মোট বেতনে ব্যয় হয় প্রায় ৬ কোটি টাকা।
জানা গেছে, আরডিএ অফিসে কর্মরতদের বেতনভাতা বাবদ চলতি বছরে সরকার অনুদান প্রদান করেছে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। যদিও এই টাকার পরিমান বেশি ছিল। কিন্তু আরডিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দুর্নীতির কারণে এই টাকার পরিমান কমিয়ে ২ কোটি ৭৫ লাখ করা হয়েছে। অথচ আরডিএ’র অন্যান্য প্রজেক্ট বাদ দিয়ে শুধু মাত্র গাড়ি থেকে প্রতি বছর যে টাকা ভাড়া আসার কথা, তা দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতনভাতা পরিশোধ সম্ভব।
আরডিএ’র কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারির ভাষ্য, অফিসে কর্মচারিদের আসা যাওয়ার যেমন রেজিষ্ট্রার রয়েছে, তেমনি গাড়ি দুটির অফিস থেকে আসা-যাওয়ার রেজিষ্ট্রার থাকলে সরকার রাজস্ব ও আরডিএ’র কোষাগারেও জমা হতো কোটি কোটি টাকা। যা কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারি দীর্ঘদিন ধরে এ টাকা লুটপাট আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
আরডিএ’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হায়াত মো: রহমতুল্লাহ জানান, বিষয়টি নিয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। কারণ আমি আরডিএ’র মুখপাত্র নই।
এব্যাপারে প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক বলেন, এই দুটি গাড়ি মাসে একদিন বা দুদিন ভাড়া হয়। আর বছওে কত টাকা জমা হয় সেটি আমি জানি না।