নদীমাতৃক দেশে বাংলাদেশ। দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী একটি জেলার নাম লালমনিরহাট। জেলার চারদিকে ঘিরে ছোট-বড় বেশ ক’টি নদী বয়ে গেছে। তার মধ্যে অন্যতম ছোট মরাসতী নদী প্রতিনিয়তই দু’পাশে মাটি ভরাট করে পাকা ঘর-বাড়ি, বহুতলা ভবন (অট্টালিকা) ও দোকানপাট নির্মাণ করে নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। নদীর পানি স্রোতের গতিপথে বন্ধ করা হচ্ছে। আর এতে শুধু মানুষেই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে না, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ, হারিয়ে যাচ্ছে দেশী ছোট বড় মাছ, জল পাখিসহ জীববৈচিত্র্য। অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণে নদী প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে নষ্টের পাশাপাশি নদী তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে। অথচ নদ-নদী বাঁচিয়ে রাখতে, কাগজে পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে তার কার্যকর নেই।
জানা গেছে, সৃষ্টিলগ্ন থেকে তিস্তার সাথে সংযোগ মরাসতী নদী। এক সময়ের খরস্রোতা মরাসতী নদী সময়ের বিবর্তনে নদীটি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রমত্ত নদী এখন দেখে মনে হবে ছোট একটি খাল। এই নদীতে এখন আর সারা বছর পানি প্রবাহ থাকে না। পলি জমে নদীর তলদেশ ক্রমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকালে পানির মৃদৃ প্রবাহ থাকলেও শুস্ক মৌসুমে নদীর বুকে বোরো ধানের ফসল ফলানো হচ্ছে। তারপরেও ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে নদী জলের জন্য করছে আর্তনাদ। এই নদীর সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত স্থানীয় অনেক কৃষকের বোর চাষাবাদের ভাগ্যলিপি।
২০১৩ সালের নদী কমিশন আইনে নদীর জমি ক্রয়-বিক্রয়, কোনো ভাবেই নদী দখল বা ভরাট করে কোনো স্থাপনা করা যাবে না। নদীর পাড় থেকে ১৫৯ মিটার দূরে থাকার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রতিনিয়তই নদীতে মাটি ভরাট করে বহুতলা ভবন (অট্টালিকা) গড়ে তোলার ফলে মরাসতী নদী এখন ক্যানেলে রুপ নিয়েছে। দেখার কেউ নেই।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, লালমনিরহাট পৌর শহরের বালাটারী ও সদরের মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের হাড়ীভাঙ্গা (ভাঙ্গাপুল) এলাকার বুকজুড়ে বয়ে যাওয়া মরাসতী নদী। এ নদী এখন প্রতিনিয়তই নদীর দু’পাশে মাটি ভরাট করে পাকা ঘর-বাড়ি, বহুতলা ভবন (অট্টালিকা) ও দোকানপাট নির্মাণ করে নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। দু’পাশে মাটি ভরাটের কারণে মরাসতী নদীর কুলকিনারা নেই। মাটি ভরাটের ফলে মরাসতী এখন ক্যানেলে পরিনিত হয়েছে। দেখে মনে হয় যে, এর চেয়ে পৌরসভার ড্রেনও বড়, এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
মুলত দৃশ্যমান; লালমনিরহাট শহরের মিশন মোড় থেকে এয়ারপোর্ট রোডস্থ বালাটারী যেতে হাতের বামে চোখ ধাঁ-ধাঁলো বহুতলা বভনগুলোই মরাসতী নদী ভরাট করে তোলা হয়েছে। ভবনগুলোর মাঝে নেই পরিসর রাস্তা, তবু ওই রাস্তা দিয়ে কিছু দুর গেলে দেখা মিলবে, মরাসতী নদীর। আর দেখা যাবে, নদীর মাঝ খানে চলছে মাটি ভরাট ও পাকা-ঘর নির্মাণের কাজ। আবার কেউ কেউ মাটি ভরাট করে পাকা বহুতলা ভবন (অট্টালিকা) নির্মাণ কাজও শেষ করেছেন। উক্ত স্থানে নদী পানি প্রবাহের জন্য পৌরসভার ড্রেনের মত একটি ক্যানেলে রাখা হয়েছে। যা মুল নদীপথ বন্ধ করে ছোট একটি ক্যানেলের মাধ্যমে এখন মুল নদীর পানি প্রবাহের গতিপথ ও অস্তিত্ব।
অভিজ্ঞমহল ধারণা বলছেন, মরাসতী নদী ভরাটে অপরিকল্পিত ভাবে এসব ভবন গড়ে ঊঠায় শহরের ড্রানের পানি নিস্কাশন বন্ধ হয়ে অল্প বর্ষায় বন্যার পানিতে শহরবাসীকে জলাবন্ধতা পড়তে হবে। অদুর ভবিষ্যত হাড়ীভাঙ্গা ও বালাটারী এলাকায় মরাসতী নদীর নাম নিশানা বলতে কিছুই থাকবে না।
এ বিষয়ে নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটির লালমনিরহাট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক বাদশা আলম বলেন, আমরা সম্প্রতি সময় নদী বাঁচাও আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৭ দফা দাবী তুলে ধরে মানববন্ধন করেছি। মরাসতী বাঁচাতে নদীটি এয়ারপোর্টে হইতে তিস্তা সংযোগ পর্যন্ত খননের প্রয়োজন। তাছাড়া নদী কমিশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের তদারকি নেই। ফলে কিছু ক্ষমতাশালী প্রভাবশারী মহল নদীতে মাটি ভরাট করে পাকা বহুতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। নদী পানি প্রবাহের জন্য নদীর পাড় থেকে কত মিটার দুরুত্ব রাখতে হবে সেই নীতিমালা কেই মানছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে মরাসতী নদীর নাম নিশানা বলতে কিছুই থাকবে না। আর এবিষয়ে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে বলে নদী বাঁচাও আন্দোলনের এ নেতা মনে করেন।
লালমনিরহাট সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিষ্ট্রেট মো. রুবেল রানা বলেন, নদ-নদী দখলমুক্ত অভিযানের উচ্ছেদ কাজ শুরু হয়েছে- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নদী শাসন করার কাজ পানি উন্নয়ন বোর্ডের। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ভূমি অধিদফতরের যৌথ সমন্বয়ে মাটি ভরাট ও অপরিকল্পিত ভাবে ভবন নির্মাণসহ দখলমুক্ত করতে পরিকল্পনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নদী রক্ষা কমিশন রয়েছে। তাদের সহযোগীতায় অভিযান পরিচালনা করা হবে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী কাদের আলী বলেন, ‘খনন না করার মরাসতী-নদীর প্রস্থ ও গভীরতা কমে প্রায় সমতল হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে পলি ও বালু পড়ে নদ-নদীগুলো ভরাট হয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। ফলে মরাসতীতে চলছে চাষাবাদ। কিন্তু নদীর ভূমির দায়িত্ব ভূমি অফিসের। আবার শহরের পানি নিষ্কাশনে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য গত বন্যার পরই আমরা নদ-নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে পুনর্ভবা, ছোট ও বড় নদীতে ড্রেজিং করার প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি।’