আত্মহত্যার দর্শন ও স্বরূপ সন্ধান

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on pinterest
Share on print

আত্মহত্যার আগে যে চিঠি লিখতে হয়, সে চিঠি লেখার ভাষা আমি জানিনা। শুনেছি সে চিঠির পঙক্তিমালায় মিশে থাকে কিশোরীর ভাঙা চুড়ির শব্দ। সেই চিঠি বিলি করা পোস্টম্যান নাকি আজীবন অন্ধ।

কেমন আছো তুমি? আমি ভালো নেই। তোমাকে নিয়ে স্বপ্নের হাজারটা জাল বুনতে বুনতে আজ আমি ভীষণ ক্লান্ত। ক্লান্ত হয়ে বুঝতে পেরেছি ভালোবাসা মানে ‘এক যোগ এক’ এই সহজ অঙ্ক মেলানোর সবচেয়ে কঠিন চেষ্টা। সবার হিসাব মিললেও আমার হিসাব অধরাই থেকে গেলো।

তোমাদের জটিলতায় আমি আর থাকতে চাই না। তোমরা যখন এই চিঠি পড়বে, তখন আমি আর থাকব না। আমার উপর রাগ কোরো না, আমি জানি তোমাদের মধ্যে অনেকেই আমাকে সত্যি ভালবাসো। আসলে সমস্যাটা আমার নিজেকে নিয়ে। অনুভব করছি আমার আত্মা এবং শরীরের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলেছে।

বিজ্ঞাপন

আমি লেখক হতে চেয়েছিলাম। বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক, কার্ল সাগানের মতো। শেষ পর্যন্ত, এই একটা চিঠি লেখার সুযোগ পেয়েছি।

আমি ভালবাসতাম বিজ্ঞান, নক্ষত্র, প্রকৃতি। কিন্তু তার পরে আমি মানুষকে ভালবেসেছিলাম, এটা না জেনেই যে তারা বহু বছর আগেই প্রকৃতি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আমাদের অনুভূতিগুলো সব নকল। আমাদের ভালবাসা মেকি। আমাদের বিশ্বাসগুলো রং মেশানো।

একজন মানুষের মূল্য এখন গিয়ে ঠেকেছে তাঁর পারিবারিক পরিচয়ে, ভোটে, একটা নম্বরে, একটা বস্তুতে। কাউকে তাঁর মন দিয়ে বিচার করা হয় না। ভেবে দেখা হয় না যে, তিনি নক্ষত্রের ধুলো দিয়ে তৈরি এক পরমাশ্চর্য সৃষ্টি। কিছু মানুষের কথা ভাবলে মনে হয় গিরগিটিও ভালো আছে।

বিজ্ঞাপন

গিরগিটি আত্মহত্যা করেছে,চিঠি লিখে গেছে, মানুষের মতো রং বদলাতে পারিনি বলে লজ্জিত। কথা গুলো প্রায় প্রতিটি আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির চিঠিপত্র, চিরকুট কিংবা ফেসবুক পোস্টের সারমর্ম করলে এমন দেখায়।

আত্মহত্যা মানবসভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকে থাকলেও গত দশকে এর হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি আত্মহত্যা নিয়ে তেমন কিছু না লিখলেও দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা যখন মৃত্যুবরণ করছে প্রতিনিয়ত, তখন আমার মানুষিক প্রেষণ এবং তাড়না আমাকে কিছু লিখতে উদ্বুদ্ধ করলো।

আত্মহত্যা আসলে ভালো নাকি খারাপ এটা করা উচিত নাকি উচিত নয়। এটার স্বরূপ সন্ধান করবো অর্থাৎ আজকের আলোচনার বিষয় আত্মহত্যার দর্শন এবং এর স্বরূপ সন্ধান। আত্মহত্যা কাকে বলে? যদি এই প্রশ্ন করা হয় তাহলে সমাজবিজ্ঞানী কিংবা সাধারণ মানুষের উত্তর হচ্ছে যখন মানুষ নিজের জীবন নিজে শেষ করে দেয়। আত্মহননের পথ বেছে নেয় তখন সেটাকে আত্মহত্যা বলে।

সাধারণ মানুষ কিংবা সমাজবিজ্ঞানীর এই সংজ্ঞা কিংবা মতবাদে বিস্তর ত্রুটি আছে। এই সংজ্ঞায়ন ঠিক না। আত্মহত্যার স্বরূপ সন্ধান করতে গেলে আমরা দ্বান্দ্বিকতা লক্ষ্য করি।

ধরেন একজন সৈনিক যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও দেশ ও জাতির জন্য জীবন দিলো। তারপর আলুর দাম না পেয়ে একজন কৃষক আত্মহত্যা করলো কিংবা নদীতে ডুবতে থাকা কাউকে বাঁচাতে গিয়ে আত্মহনন করলো অথবা ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিউনিসিয়ার এক গভর্নর অফিসের সামনে অসহায় ফেরিওয়ালা নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহনন করেছিলেন। জীবনযুদ্ধে মোহাম্মদ বুআজিজি নামের লোকটি এক পরাজিত সৈনিক। তিনি কোনোভাবেই পরিবারের ভরণপোষণ করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না। তার দুঃখ এবং সংসার-সংগ্রাম দুঃখী অনেক তিউনিসিয়ানের জীবনগাথার মতোই। তিউনিসিয়ার মন্দ অর্থনীতি, বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অতিষ্ঠ মানুষের কাছে বুআজিজি নতুন বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তা ছিল সংগ্রাম ও বিদ্রোহের বার্তা। তিউনিসিয়া থেকে সে বার্তা আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বুআজিজি সংগ্রামের প্রতীকে পরিণত হন। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনাবলির জের ধরে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বেন আলীর ২৩ বছরের শাসন শেষ হয় গণবিক্ষোভের কারণে। বুআজিজির সেই আত্মহত্যা আজ আরব বসন্ত নামে পরিচিত। আত্মহত্যা ভালো নাকি খারাপ সেটা নির্ভর করে উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায়ের উপর। কখনো একটি আত্মহত্যা একটি স্টেটমেন্ট একটি প্রতিবাদের ভাষা, শোষণ উৎপীড়নের মোক্ষম জবাব।

তাহলে ঢালাওভাবে আত্মহত্যাকে নিন্দনীয় বলার সুযোগ থাকছে না। তাহলে আত্মহত্যা সমর্থনযোগ্য এবং নিন্দনীয় দুটোই হতে পারে।

এবার কখন একটি আত্মহত্যা নিন্দনীয় সেটির স্বরূপ সন্ধান করবো।

বাংলাদেশের আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করলে প্রতীয়মান হয় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবনতা বেশি এবং কারণ হিসেবে যে বিষয় উঠে আসে প্রেম, বিরহ,দাম্পত্যকলহ এবং নারীঘটিত কেলেঙ্কারি আর আর্থিক টানাপোড়ন।

মোটাদাগে বললে বাংলাদেশি কিশোরকিশোরীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ প্রেম,ভালোবাসা এবং অতিরিক্ত আত্মসম্মানবোধ। নোয়াম চমেস্কির মতে প্রতি এক দশকে সময়ের সাথে অর্থনীতির কাঠামো যেমন পরিবর্তন হয় তেমনি সমাজ এবং সমাজের মূল্যবোধগুলোও পরিবর্তন হয়। মানুষ আর আগের মতো স্থির না। কালচারাল হিজিমনির কারণে ধর্মীয় এবং সামাজিকতার উর্ধ্বে গিয়ে চিন্তা করছে।

যারা আত্মহত্যা করছেন বা করবেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা। আপনি একবার চিন্তা করুন মানুষের মতো এত চমৎকার সৃষ্টি আর কী পৃথিবীতে আছে? আর যে জীবন নিজে সৃষ্টি করতে পারবো না তা ধ্বংস করার অধিকারো আমার নাই।জীবন এবং মরণের ফয়সালা মহান স্রষ্টার হাতে রাখাই ভালো। আত্মহত্যা করা মানে স্রষ্টার অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। স্রষ্টার ক্ষমতায় ভাগ বসানোর মতো দুঃসাহস করা।

তাহলে চিন্তা করুন প্রেম বা ছেলে-মেয়ের সম্পর্কের কারণে এমন আত্মহননের পথ বেছে নিলে কিভাবে ট্রিট করবে স্রষ্টা আপনাকে।

এবার ধর্মীয় দৃষ্টি কোণের বাইরে থেকে চিন্তা করি আত্মহত্যা করার নৈতিকতা নিয়ে। এক লোকের বউ মারা গেছে অল্প কিছুদিন হলো সে বিয়ে করার জন্য পাত্রী দেখা শুরু করেছে। বাড়ির মুরব্বি তারে বললো বউয়ের কবরের মাটি না শুকানো পর্যন্ত বিয়ে করা যাবে না। তখন এই লোক পাখা নিয়ে গিয়ে কবরে বাতাস করতেছে তাড়াতাড়ি মাটি শুকানোর জন্য, যাতে দ্রুত বিয়ে করতে পারে।

চিন্তা করে দেখুন বউ মারা গেলে যে জাতি কবরে বাতাস করতে পারে। তাদের প্রতি অভিমান, আক্ষেপ করে মরলে কতদিন আপনাকে মনে রাখবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী পরশুদিন দশতলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করছে মেয়ে তাকে পাত্তা দেয় না বলে। আচ্ছা মেয়েটার সাথে সম্পর্ক তোমার কয়দিনের হয়তো এক-দুই বছরের জন্য তার অল্প সময়ের ভালোবাসার জন্য এত উতলা? যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ছাঁদ থেকে তুমি লাফ দিয়েছো তোমাদের সেই ভবন আর পড়াশোনার খরচ যোগাতে এদেশের লক্ষ কোটি দিনমজুর,কৃষক, শ্রমিকদের রক্ত পানি করা ট্যাক্সের টাকা আছে। তাদের এই কষ্টার্জিত টাকা তোমাকে লীলাখেলা করার জন্য তাঁরা দিচ্ছে না। কোন মেয়ে বা ছেলের কারণে মরার জন্য না তাঁরা টাকা দিচ্ছে না। তার ট্যাক্স দেয় এই দেশের সেবক তৈরির জন্য। তাঁরা প্রেমিক-প্রেমিকা তৈরির জন্য ট্যাক্স দেয় না।তাদের এই ঋণ কিভাবে পরিশোধ করবে?

আর যে ছেলেটা মারা গেল একটি পত্রিকা তার পরিবারের বর্ণনায় লিখেছে পেশায় মা গৃহিণী। আমার আবার মায়ের পেশায় কেউ গৃহিণী লিখলে রাগ হয়, কষ্ট পাই। সমাজে নানান পেশাজীবির মানুষ আছে আমরা তাদের চাকরিজীবী বলি। আমি আমাদের মায়েদের স্বপ্নজীবি বলি। আমাদের মায়েরা যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করে আমাদের জন্ম দেয় তখন থেকে তারা স্বপ্ন দেখে ছেলেটা বা মেয়েটা ভালো কিছু করবে। তাঁদের স্বপ্ন দেখাই কাজ তাই আমি মায়েদের পেশা হিসেবে বলি, মা হচ্ছে স্বপ্নজীবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছেলেটি তার চিরকুটে লিখেছে মা তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না। সেই ছেলের এই ছোট্ট কথায় একজন স্বপ্নজীবির মৃত্যু হয়েছে। সেই মা আর স্বপ্ন দেখবে না। সমাজ, রাষ্ট্র এবং পরিবারের এতসব ঋণ, এতসব দায়-দেনা অস্বীকার করে কেউ যখন অবিবেচকের মতো আত্মহননের পথ বেছে নেয়, তখন নিজের অজান্তেই প্রমাণ করে দেয় সে একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন আত্মকেন্দ্রিক তুচ্ছ মানুষ। প্রেমের কারণে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্তকে আমরা কখনোই মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থন করতে পারি না। তাই আত্মহত্যার স্বরূপ অন্বেষণ করে আমি বলবো প্রেম, বিচ্ছেদের কারণে জীবনের মতো এত মূল্যবান সৃষ্টিকে ধ্বংস করা নৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থন যোগ্য নয়।

আসাদুজ্জামান বুলবুল
শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
bulbulhasan442@gmail.com

শীর্ষ সংবাদ:
‘এক মাসে বিএনপির ২০ হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার’ বিএনপি একটি অগণতান্ত্রিক তাই তারা নির্বাচনে আসেনা: স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আওয়ামী লীগের চিন্তা-চেতনা শুধুই মানুষের উন্নয়নের: মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া মাদক ব্যবসায়ীদের হামলায় ডিবি পুলিশের দুই সদস্য আহত , আটক ৩ আমার কর্মীদের উপর হামলা হলে আমরা ঘড়ে বসে থাকবো না উচিত জাবাব দিব: এমপি সীমা চাকরি পেলেন শ্রমিক আন্দোলনে নিহত জালালের স্ত্রী নৌকার টিকিটে লড়বেন যেসব নারী কোন স্বতন্ত্র মতন্ত্র আমরা চিনি না, মাইরের ওপর কোন ওষধ নাই: ছাত্রলীগ নেতা রিমন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও স্বাভাবিক ভাবে চলছে পরীক্ষা ও ক্লাস কালাইয়ে ফার্মাসিস্ট দিয়ে চলছে দুই উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র সাতক্ষীরায় সরসকাটি দাখিল মাদ্রাসায় নিয়োগে বাণিজ্যের টাকা সভাপতির পকেটে গাজীপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন এমপি সবুজ গাজীপুরে বাসে আগুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে এমপি পদ ছাড়তে হবে না: ইসি রাজশাহীতে ককটেল হামলায় দুইজন আহত, তিনজন আটক রাজশাহীর আদালত চত্বরে ককটেল বিস্ফোরণ, পরিচ্ছন্নকর্মী আহত জয়পুরহাট পিকআপ ভ্যানে আগুন দেওয়ায় আসামী গ্রেফতার মোংলায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে অবস্থানে কর্মসূচি মাটিরাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক গ্রেফতার ডিবি কার্যালয়ে শামীম ওসমান